
দুর্নীতিবাজদের দমন ও সুনাগরিকদের সামনে নিয়ে আসুন

ড. ফখরুল ইসলাম বাবু : বাংলাদেশ সম্প্রতি ১.৫ মিলিয়ন টাকা মূল্যের একটি কোরবানির ছাগল নিয়ে আলোচনায় নিজেকে আলোড়িত করেছে। এই ঘটনাটি জাতির দাবি করা দ্রুত ‘উন্নয়নের প্রতীক, যেখানে ১.৫ মিলিয়ন টাকার ছাগল ও ১৫ মিলিয়ন টাকার গরু বাস্তবে পরিণত হয়েছে। অধিকাংশ নাগরিক নিছক দর্শক হয়ে থাকলেও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদরা সক্রিয়ভাবে খেলাটি খেলছে। সাধারণত, আমরা গ্র্যান্ড স্টেডিয়াম থেকে এই ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করি। মাঝে মাঝে ঝুঁকি কম হলে আমরা ধূমকেতুর মতো উঠি। সম্প্রতি একটি বহুল প্রচারিত পত্রিকার সম্পাদক স্বীকার করেছেন যে তিনি সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের দুর্নীতি সম্পর্কে জানতেন কিন্তু তা প্রকাশ করার সাহস তার নেই। ছাগল ক্রেতার সঙ্গে আলোচনা করা সামান্য ঝুঁকি জড়িত এটি একটি নিরাপদ বিষয় করে তোলে। ছাগল নিয়ে আলোচনায় ভেসে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। প্রাথমিকভাবে এটি ইতিবাচক বলে মনে হচ্ছে। আদর্শভাবে সরকারি সংস্থাগুলোর উচিত দুর্নীতিবাজ, ঋণখেলাপি ও অর্থ পাচারকারীদের চিহ্নিত করা। তবে এই দায়িত্ব চলে এসেছে দায়িত্বশীল সাংবাদিক ও নেটিজেনদের ওপর।
সোশ্যাল মিডিয়া এমন একটি প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে যেখানে লোকেরা ‘চোর ও প্রতারকদের সম্পর্কে জানতে পারে, তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারে, বঞ্চিত ও অধিকার বঞ্চিতদের নিয়ে মজা করতে পারে। এখানে নেটিজেনরা অপরাধীদের জনগণের আদালতে নিয়ে আসে। এই সিস্টেম ক্ষতিকারক দিক সত্ত্বেও একটি প্রয়োজনীয় আউটলেট প্রদান করে। সোশ্যাল মিডিয়া না থাকলে অনেক বিষয় লুকিয়ে থাকবে ও অযৌক্তিক থাকবে। ছাগলের গল্প এই ঈদে কোরবানির পশুর অসামান্য আকার, দাম ও জাঁকজমকপূর্ণ কেনাকাটা থেকে জানা যায় দেশের টাকা কোথায়, কারা রপ্তানি করতে ব্যস্ত। দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিক প্রকৃতি সাধারণ মানুষকে কাঁপতে কাঁপতে যথেষ্ট। অনেক সরকারি কর্মচারী তাদের দুর্নীতিতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিগুলো সরকারি চাকরি প্রত্যাশীদের জন্য প্রস্তুতির স্থলে পরিণত হয়েছে। যারা সরকারি চাকরিতে অবতরণকে আর্থিক ও সামাজিক মুক্তির প্রতিশ্রুতি হিসাবে দেখে, সীমাহীন ক্ষমতা প্রয়োগ করার সুযোগ দেয়। একবিংশ শতাব্দীতে অন্যদের দাসত্ব ও প্রভু হওয়ার সহজ উপায় আর কী আছে? তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে শীর্ষ পদে থাকা সত্ত্বেও অনেকেই নির্বাহী ক্ষমতার চাকরির দিকে ছুটে যান। শিক্ষকদের সীমিত বেতন, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় নিয়োজিত থাকার বাধ্যবাধকতার পরিপ্রেক্ষিতে এমন বাস্তবতায় কে যুক্ত হতে চাইবে?
এমনকি যারা সরকারি চাকরিতে একাধিক বিকল্প রয়েছে তারা অবৈধ উপার্জনের জন্য বা আরও শক্তিশালী হওয়ার জন্য আরও সুযোগ সহ অবস্থানগুলো সন্ধান করে। ভূমি প্রশাসন ব্যবস্থায় দুর্নীতি ও অবৈধ উপার্জনে উদ্বুদ্ধ হয়ে সম্প্রতি কেউ সরকারি ক্যাডার থেকে সাব-রেজিস্ট্রারের চাকরিতে পেশা পরিবর্তন করেছেন। দুর্নীতি একটি সিন্ডিকেটেড অপরাধ ও এটি শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির দ্বারা পরিচালিত হতে পারে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যখন দুর্নীতি দেখা দেয়, তখন তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে এই অপরাধটি করার জন্য একটি নেটওয়ার্ক গঠন করে। যাতে বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তিরা জড়িত যারা অন্যান্য সুবিধা ভোগ করে। এমনকি নিম্ন-গ্রেডের কর্মীরা সম্পদের পাহাড় সংগ্রহ করতে পারে। আমরা দেখেছি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চালকরা দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার মালিক হচ্ছেন। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে কোনো স্তরেই দুর্নীতি গোপন থাকার কথা নয়। কিন্তু তা গোপন রাখা হয় অলিখিত চুক্তির মাধ্যমে।
দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি দুর্নীতি থেকে বিভিন্ন সুবিধা পেতে পারে, দেশ ও এর জনগণ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একজন রাজস্ব কর্মকর্তা দুর্নীতিতে লিপ্ত হলে দেশ রাজস্ব হারায়। আইন প্রয়োগকারীরা দুর্নীতিগ্রস্ত হলে মানুষ তাদের নিরাপত্তা হারায়। সরকারি চিকিৎসকরা দায়িত্বে অবহেলা করলে মানুষ তাদের কাক্সিক্ষত স্বাস্থ্যসেবা হারায়। বিচারকরা দুর্নীতিগ্রস্ত হলে মানুষ তাদের শেষ অবলম্বন হারায়। তাই দুর্নীতি সুশাসনের জন্য মারাত্মক হুমকি। একটা সময় ছিলো যখন রাজনৈতিক সরকারের মেয়াদ শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অনেক দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি তাদের বাড়ি, গাড়ি ও টাকার ব্যাগ ফেলে পালিয়ে যেতো। আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের আগে ও পরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্রুসেড ঘোষণা করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা কোনো না কোনো কারণে সেই প্রতিশ্রুতি থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছে। বহু বছর ধরে এদেশের মানুষ দুর্নীতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। দায়মুক্তির সংস্কৃতি দুর্নীতিকে চরমে পৌঁছে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শোক প্রকাশ করেছিলেন যে তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে চোরের ‘মাইন’ পেয়েছিলেন। জীবদ্দশায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে বহু কালজয়ী বক্তৃতা দিলেও তা দূর করার মতো সময় পাননি। স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকারকে এখনও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। বেশিরভাগ সরকারই তাদের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে নির্বাহী শাখায় অতিরিক্ত দুর্নীতিতে লিপ্ত হয়েছে।
দুর্নীতিবাজদের দমনের পরিবর্তে বারবার তাদের তুষ্ট করা হয়েছে। দুর্নীতির কারণে বড় বাজেটের পরিমাণ থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্র তার কাক্সিক্ষত রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয় ও জনসাধারণ এখনও তার সরকারি পরিষেবা পেতে লড়াই করে। অন্যদিকে মানুষ ফেসবুকে লাইক-কমেন্ট করে দিন কাটায় দুর্নীতিবাজদের দানব ছাগল-গরু দেখে। দৃশ্যমান কঠোর শাস্তির অভাবে দুর্নীতি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। তবে দুর্নীতিবাজদের ছবি, তথ্য, গল্প যদি দায়িত্বশীলভাবে মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়। তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করা হয় তাহলে এর কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে। ঠিক যেমনটি ঘটেছে এই ‘গট’ ঘটনার ক্ষেত্রে। উপসংহারে ছাগলের গল্প আমাদের সমাজের গভীরে প্রোথিত ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির উপর আলোকপাত করে। যদিও সোশ্যাল মিডিয়া নির্দিষ্ট বিষয়গুলোকে আলোতে আনতে পারে ও জনসাধারণের বক্তৃতা তৈরি করতে পারে। চূড়ান্ত সমাধান হলো পদ্ধতিগত ও আইনি সংস্কার। শুধুমাত্র কঠোর দুর্নীতি বিরোধী পদক্ষেপ, স্বচ্ছ শাসন ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে জাতি এই ব্যাপক সমস্যাকে রোধ করতে ও কিছু দুর্নীতিবাজের পরিবর্তে সমস্ত নাগরিকের সুবিধার জন্য জনসাধারণের সম্পদ ব্যবহার করা নিশ্চিত করার আশা করতে পারে। লেখক: সভাপতি, এশিয়ান ক্লাব লিমিটেড, হংকং। অনুবাদ : জান্নাতুল ফেরদৌস। সূত্র : ডেইলি সান
