
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কী আছে, কী নেই?

শামীম আহমেদ
১. খেলা পারে না : আমাদের ক্রিকেটাররা খেলা পারে না। মজা করতেছি না, একদমই সিরিয়াস। নির্মোহভাবে খেলা দেখেন। আমাদের কোনো আন্তর্জাতিক মানের ব্যাটার, বোলার বা ফিল্ডার নাই। আসলেই নাই। আমি জানি আপনি দুই-চারজনের নাম বলবেন। কিন্তু তারা আন্তর্জানিক মানের না। একজনও না। ২. স্কিল নাই : অর্থাৎ আমাদের খেলোয়াড়দের স্কিল নাই ভাই। একদমই নাই। কঠিন বলকে চার-ছয় বানানো হচ্ছে স্কিল। কঠিন পিচে মাথা খাটায়ে ব্যাটারের ফুট মুভমেন্ট বুঝে বলের লাইন-লেন্থ চেঞ্জ করে তাকে প্রলুব্ধ করা, কিংবা ইয়র্কার দিয়ে আউট করা হচ্ছে স্কিল। নাই এটা আমাদের কারও। ৩. চেষ্টা নাই : হাফ চান্স ক্যাচ ধরে ফেলা, নিশ্চিত চার হয়ে যায় সেই বল উড়ে যেয়ে ধরে ফেলা হচ্ছে স্কিল। গত দুই ম্যাচে তাওহীদ হৃদয় বা সাকিবের মিস করা ক্যাচগুলা বলে আমাদের ফিল্ডিংয়ে স্কিল নাই। এক রানের শটে দৌড়াতে না পেরে দুই রান দেওয়া রিয়াদের দৌড় বলে আমাদের ফিল্ডিংযে স্কিল নাই ভাই, একদমই নাই।
৪. পুরস্কার বা তিরস্কার : ভালো করলে পুরস্কার, খারাপ করলে তিরস্কারÑ এটা সার্বজনীন। আপনার সন্তান থেকে স্কুলে, কর্মক্ষেত্রে সব জায়গায়। এই পুরস্কার আর তিরস্কারের ব্যবস্থা না থাকলে মানুষ ভালো কিছুর জন্য কাজ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। জনস্বাস্থ্য ও সাইকোলোজিতে এই জিনিসটা আমরা ছাত্রদের পড়াইÑ চড়ংঃরাব ৎবরহভড়ৎপবসবহঃ ধহফ ঘবমধঃরাব ৎবরহভড়ৎপবসবহঃ হিসেবে। এই জিনিস নাই আমাদের দেশে। ৫. বিশৃঙ্খলা : আমাদের ডিসিপ্লিন নাই। আমরা ২০ দিনে ৪ দিন প্র্যাক্টিস করি। ইচ্ছা মতো খেলার আগে দাওয়াত খেতে পারি, ইদের দিন সকালে পরোটা গোশত খেয়ে বিকেল বেলা ম্যাচ খেলতে নামি। নাই আমাদের কোনো শৃঙ্খলা ভাই, একদম নাই। ৬. ফিটনেস নাই : আমাদের শারীরিক ফিটনেস নাই। সমুদ্র থেকে হাওয়া দিচ্ছে, আপনি হাওয়ার অনুকূলে ছক্কা হাঁকালেন, সেই বল গিয়ে লোপ্পা ক্যাচ হইলো প্রতিপক্ষের ফিল্ডারের হাতে। মাঠের সবচেয়ে ছোটদিকে পিটায়ে বল মাঠ ছাড়া করার দক্ষতা নাই আমাদের।
৭. মেন্টাল হেলথ ইসু : আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা খুব খারাপ। কয়েক যুগ আগে দেখতাম নান্নু, বুলবুল মাঠে ঢোকে আর আউট হয়ে মাথা নিচু করে চোরের মতো মাঠ থেকে বের হয়। এখন মাঠ থেকে বের হবার সময় চোরের মতো বের হয় না, কিন্তু জেতা ম্যাচ হেরে আসা, চ্যালেঞ্জ না নিতে পারার ব্যর্থতা মানসিক স্বাস্থ্যের দুর্বলতার লক্ষণ। আপনি জানেন কিনা জানি না, বেশির ভাগ মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের যে সমস্যা সেগুলোর সূত্রপাত তার শৈশবে। আপনি আপনার জামাই-বউ বা বসের সাথে কেমন ব্যবহার করেন সেটা ৭০ ভাগ নির্ভর করে আপনার শৈশবে আপনার বাবা-মা-পরিবার-প্রতিবেশী-শিক্ষক আপনার সাথে বা একে অপরের সাথে কেমন ব্যবহার করে তার উপরে। বানায়ে বলতেছি না ভাই, এই বিষয়ে পড়াই। পড়াইতে যেয়ে নিজেই আতঙ্কে থাকি আমাদের অজান্তে আমাদের মনস্তত্বে কত বড় বিপর্যয় হয়ে গেছে আমাদের শৈশবে। তবে ব্যাপারটা হচ্ছে মানসিক অসুস্থতা স্বাভাবিক এবং ১০০ শতাংশ মানুষেরই এটা আছে, তা জেনে, প্রতিকার সম্ভব। কিন্তু আমাদের ক্রিকেটার এবং আমাদের নিজেদের কারওই সেই যথাযথ চিকিৎসা হয় নাই। তাই সেমিফাইনালে খেলতে হলে লড়াই করতে হবে, সেই মানসিক দৃঢ়তা আমাদের ক্রিকেটারদের নাই।
৮. ঈড়ৎৎঁঢ়ঃবফ নড়ধৎফ, সধহধমবসবহঃ : আমাদের কোচ, আমাদের বোর্ড অথর্ব। আমরা দেশের বিরুদ্ধে, দলের স্বার্থে যথেচ্ছার করা জাতীয় কোচ বা বোর্ড প্রধানকে বছরের পর বছর পেলে যাচ্ছি। কোনো শাস্তি নাই, বরখাস্ত করা নাই, তারা যা ইচ্ছা বলে। তাদের কারণে দেশের শীর্ষ দুই ক্রিকেটারের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে টপ অর্ডার ভঙ্গুর। তাদের কারণে মাত্র কয়েক মাস আগের বিশ্বকাপের শুরুতে ক্রিকেটাররা যার যা ইচ্ছা মতো মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার দিয়ে দলের আস্থা নষ্ট করে দিলো, আর এই বিশ্বকাপে একেকদিন একেকভাবে ব্যাটিং-বোলিং অর্ডার সাজিয়ে যেমন ইচ্ছা তেমন খেলতে পারল। দেশের ভেতর বয়সভিত্তিক ক্রিকেটার তৈরির কোনো উদ্যোগ নাই, ইনফ্রাস্ট্রাকচার নাই জেলা এমনকি বিভাগীয় পর্যায়ে, অথচ বোর্ড বসে আছে ৯০০ কোটি টাকা নিয়ে।
৯. বিপজ্জনক সাংবাদিকতা, রহংবহংরঃরাব ভক্ত : আমাদের মিডিয়া, আমাদের ভক্তদের মধ্যে কোনো দায়িত্ববোধ নাই। জাস্ট টি-২০ বিশ্বকাপে আমাদের খেলা নিয়ে যারা রিপোর্ট করে তাদের রিপোর্টের মান দেখেন। অনফিল্ডের ছেলেটা আর অৎরভঁষ ওংষধস জড়হবু-এই দুইজন ছাড়া আর একজনও দায়িত্ব নিয়ে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সাংবাদিকতা করেন না। তারা মন মতো তথ্য বানান, তথ্য ছড়ান, ভক্তদের সাথে ক্রিকেটারদের দূরত্ব বাড়ান, গুজব ছড়ান।
১০. খেলা, রাজনীতি ও ধর্মের মিশ্রণ : ভক্তদের নিয়ে আরেকটা পয়েন্ট লিখতেই হবে, অপ্রিয় হলেও সত্য। আমরা দেশের জন্য দলের জন্য ক্রিকেটারদের ভালোবাসি না, ঘৃণাও করি না। করি আমাদের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থান থেকে। যারা এন্টি-ইসলাম তারা মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মুশফিকুর রহিম, তানজিম সাকিবকে দেখতে পারেন না। আমি বাজি ধরে বলতে পারি কিছুদিন পর লেগ স্পিনার রিশাদ যদি একটু খারাপ করে বা মাঠের সাইডে-সুইডে এক দুইবেলা নামাজ পড়ে ফেলে, সেও তাদের বাতিলের খাতায় পড়ে যাবে। আরেক গ্রুপ সাকিব আর মাশরাফিকে দেখতে পারে না, তারা আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য বলে। একটা বড় অংশ লিটন আর সৌম্যকে দেখতে পারে না তারা হিন্দু বলে। এটা অবিশ্বাস্য যে একটা দেশের মানুষ দলের আর দেশের স্বার্থের চাইতে রাজনীতি আর ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে নিজেদের মধ্যে তিনভাগ হয়ে যায়। আমি সাকিবকে তখন থেকে পছন্দ করি, যখন সে আওয়ামী লীগের ধারে কাছে ছিল না। আমি সাকিব তানজিমকে পছন্দ করি তার আগ্রাসী মনোভাবের জন্য। আমরা বড় হবার সময় অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের বোলারদের এমন আগ্রাসী হতে দেখেছি। আমি মুশফিকুর রহিমকে পছন্দ করি তার ব্যাটিংয়ে জান-প্রাণ দিয়ে খেলার মানসিকতার জন্য। এদের কাউকে আমি তাদের রাজনীতি ও ধর্ম কিংবা ধর্মহীনতার জন্য পছন্দ বা অপছন্দ করি না। কিন্তু দেশের ভেতর এই জিনিসটি খুবই জোরদার।
অনেককে দেখি আওয়ামী লীগ করেন, সরকারের অন্ধ ভক্ত কিন্তু আমরা কেন খেলা দেখে সাকিব তানজিম বা সাকিব আল হাসানকে পছন্দ করি বা মাঝে মাঝে রিয়াদের প্রশংসা করি সেটার ভিত্তিতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ নিয়ে প্রশ্ন করেন। তাদের অনেককে প্রধানমন্ত্রী নাম ধরে চেনেন, গণভবনে চায়ের দাওয়াত দেন। আমার প্রশ্ন আপনারা যদি রিয়াদ-মুশফিক আর সাকিব তানজিমকে জঙ্গি মানেন, জামাত মানেন, তাহলে আপনারা প্রধানমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেন তারা বাংলাদেশ দলে কেন? আমাকে কেন জিজ্ঞেস করেন? আমি আমার দেশকে যারা প্রতিনিধিত্ব করেন, তাদের সমর্থন করি। তারা যদি জামাত হয়, সেটি আপনি ও আপনার প্রধানমন্ত্রী মিলে ব্যবস্থা নিন।
১১. দুর্নীতি : দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ছড়িয়ে গেছে, ক্রিকেট তো দেশের বাইরের কোনো বিষয় নয়। ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের খেলার দিনের অনেকগুলো সিদ্ধান্ত, ক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ, সেদিন বাংলাদেশ ওইসব আজগুবি সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছিল তার সাথে দুর্নীতির সংযোগ আছে কিনা কে জানে। ক্রিকেটে বেটিং তো এখন সর্বজনবিদিত। আমাদের লোকাল ক্রিকেটে খেলার ফল কোথায় হয় আপনারা জানেন কিনা আমি জানি না। রাগে সাকিব লাথি দিয়ে উইকেট ভেঙে ফেলছে এটিকে আপনারা বলেন অভদ্রতা, কিন্তু তার পেছনে যে পাতানো খেলার বিরুদ্ধে তার রাগ-ক্ষোভ এটা হয়তো অনেকেই জানেন না। আমেরিকার খেলোয়াড়রা চাকরি করে খেলতে নামেন। কেউ কেউ উবার করে তারপর খেলেন। আমাদের শৈশবে আমাদের মিতব্যয়ী হতে শেখানো হয়েছে। আমার আব্বা সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে যখন অবসরে যান, তখন আমাদের ঢাকায় কোনো ফ্ল্যাট ছিল না, কোনো গাড়ি ছিল না। আমার বড় হওয়া জীবনে কখনও বাসায় কোনো ভিডিও গেইম, আটারি, এক্স-বক্স ছিল না। নটর ডেমে দুটো বাস পাল্টে ক্লাস করেছি দুইবছর। কারণ আমার আব্বা মহান কেউ ছিলেন এটা বলছি না, তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন এবং তার বেতনে এর বাইরে কিছু করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। এখন দেখি বিসিএস দিয়ে মানুষ টয়োটা এলিয়ন চালিয়ে অফিস করতে গাজীপুর টঙ্গি যায়, ঢাকার বাইরে পোস্টিং হলে তাদের স্বামী-স্ত্রী-সন্তান থাকে গুলশান-বনানীতে। তাদের ছেলে-মেয়েরা পড়ে স্কলাস্টিকায়, আর আমরা পড়েছি যশোর-খুলনার সাধারণ স্কুলে, ঢাকায় পড়েছি মিরপুর বাংলা স্কুলে। সেখান থেকে সারা জীবন সব জায়গায় বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জন করেছি। জীবনে প্রথম গাড়ি চালিয়েছি নিজের বেতনে কেনা গাড়িতে। এর বিপরীতে এখনকার সরকারী কর্মকর্তা বা এখনকার তরুণদের অবস্থা বিবেচনা করুন। বাপের টাকায় বিত্ত-বৈভবে জীবন শুরু করে তারা নিজের প্রাপ্তির বিষয়ে কী শ্রম দেবে?
১২. দেশপ্রেমের অভাব : অনেক পয়েন্ট নিয়ে লেখা যায়, কিন্তু আপাতত আরেকটা পয়েন্ট দিয়ে শেষ করি, সেটা হচ্ছে দেশপ্রেম। আমাদের দেশপ্রেমের অভাব প্রকট। আমাদের কাছে দেশের চাইতে রাজনীতি বড়। আমরা মুক্তিযোদ্ধার কোটা বাতিল কিংবা নিরাপদ সড়ক চাইয়ের মতো কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডায় উদ্বেলিত হয়ে দেশ কাঁপিয়ে ফেলি, কিন্তু কোনো সরকারি কর্মকর্তা ৩০০ কোটি টাকা নিয়ে গেলে বা কোনো প্রতিষ্ঠান ৩০ হাজার কোটি টাকা পাচার করলে সেটা নিয়ে ট্রল করি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ পুরোই রাজনীতিকেন্দ্রিক। দেশের বাইরে থাকলে দেশ নিয়ে কিছু বলা যাবে না, অথচ দেশের বাইরে থেকেই দেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখছেন মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমিকেরা আর নর্থ আমেরিকা, ইউরোপের স্কলাররা জীবন দিয়ে যাচ্ছেন সামাজিক অবকাঠামো নিয়ে লিখতে লিখতে। আমাদের দেশপ্রেম আসলেই কম। আমরা আসলেই সোনার বাংলা নই। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে জয় আসলেই একটা বিস্ময়। আমাদের মধ্যে হীনমন্যতা, অন্যকে ছোট করার প্রচেষ্টা, পরশ্রীকাতরতা, ছিদ্রান্বেষী মনোভাব এত তীব্র আমি আর কোনো জাতির মধ্যে দেখিনি। আমি এ বিষয়টি আগে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করতাম কিন্তু গত একবছর ধরে দুঃখের সাথে লিখে যাচ্ছিÑ বাঙালিরা জাতি হিসেবেই খারাপ, আমরা অন্যের ভালো দেখতে পারি না। আমরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করি না, দুর্নীতিকে ঠেসে ধরি না। যতটুকু করি সেটি রাজনৈতিক কারণে, তার মধ্যে দেশপ্রেমের বিন্দুমাত্র নেই। যতদিন পর্যন্ত আমাদের সব বিভাজন দল, রাজনীতি ও ধর্মকেন্দ্রিক হবে ততদিন আমি জাতি হিসেবে কেবল অধঃপতনই দেখছি- আমাদের ক্রিকেট, এর ব্যতিক্রম কিছু নয়। ধন্যবাদ।
২৫ জুন ২০২৪। লেখক ও গবেষক
