
বাংলাদেশকে ভিয়েতনাম হতে হলে যে দুটি কাজে হাত দিতে হবে

কাজী এম. মুর্শেদ
কোনো এক নিউজে দেখেছিলাম কেউ একজন বলছিলেন, সম্ভবত রেহমান সোবহান; বাংলাদেশ ভিয়েতনামের পথে যাবে, শ্রীলংকার পথে যাবে না। ভিয়েতনামের পথে যাওয়া ভালো, শ্রীলংকার পথ খারাপ, তাই তো? ভিয়েতনাম স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৪৫ সালে, তৎকালীন ভারত-পাকিস্তান বিভাজন হয় ১৯৪৭ সালে। এরপর ১৯৫৫ থেকে ১৯৭৫Ñ এই ১৯ বছর যুদ্ধের পর দুই ভিয়েতনাম একীভূত হয়, আর ১৯৭১ সালে ৯ মাস যুদ্ধের পর বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটাকে গড়ে তুলতে ভিয়েতনাম সরকার কাজ শুরু করে, এখন একটা মডেলের পর্যায়ে উঠে আসছে। ভিয়েতনামের জনসংখ্যা বাংলাদেশের অর্ধেকের মতো হলেও আয়তনে দ্বিগুণের বেশি। সাগরের অনেকটা অংশ তাদের সঙ্গে থাকায় ১৪০টার মতো পোর্ট ও ডিপ সী পোর্ট নির্ণয় করা আছে। বিভিন্ন সময়ে ৪০ টার মতো পোর্ট কাজ করে। জিডিপি হিসেবে বাংলাদেশের মতো, তবে জনসংখ্যা কম হওয়ায় মাথাপিছু আয় বেশি। ভিয়েতনামের উন্নয়নের পেছনে আমি যে কারণগুলো দেখি তার মধ্যে প্রধান হলো, একদলীয় মার্কসবাদ লেনিনবাদ সমাজতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা হলেও তারা অর্থনীতির ব্যাপারে অত্যন্ত উদার। তারা পুরোই ক্যাপিটালিস্ট মার্কেট ইকোনোমিতে আছে, সরকার বিভিন্ন প্রণোদনা দেয়, যা কাজে লাগে। শিক্ষা ব্যবস্থায় কয়েকধাপ এগিয়ে, উন্নত টেকনোলজির সঙ্গে তারা শিক্ষা ব্যবস্থা বদলায়। বেকারত্বের হার প্রায় নেই বললে চলে, যা আছে সেটা থাকতে হয় না হলে যারা অবসরে যাবে তাদের জায়গা নেওয়ার লোক থাকতে হয়। ২.৫ শতাংশ যেখানে আইডিয়াল সংখ্যা সেখানে বেকারত্ব ২.৩ শতাংশ আছে। আরও কারণ আছে। ৮৬ শতাংশের ওপর মানুষ ধর্ম নিয়ে কোনো ভাবনা চিন্তা নেই। সবচেয়ে বেশি ধার্মিক হলো ৬ শতাংশ ক্যাথলিক, এরপর ৫ শতাংশ বুদ্ধিস্ট।
তারা ১৯ বছরের আমেরিকার যুদ্ধ নিয়ে পরেনি, বরং তাদের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক পার্টনার আমেরিকা। ২২০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির মধ্যে ৭০ বিলিয়নের উপর আমেরিকায়। ইলেকট্রনিক্স, মাইক্রোপ্রসেসর, কমিউনিকেশন ডিভাইস, কৃষি এসব খাতে তাদের মূল অর্থনীতি নির্ভর করে। আমরা যে তৈরি পোশাকে দ্বিতীয় স্থানে তার কারণ বাংলাদেশ তৈরি পোশাকে ভালো করেনি। বরং ভিয়েতনাম তৈরি পোশাক থেকে পিছিয়ে এসেছে। ভিয়েতনাম পর্যটনেও ভালো করছে, তারা হুটহাট শুরু করেনি, বরং খুব গুছিয়ে সময় নিয়ে ট্যুরিজম স্পট, যোগাযোগ, রিসোর্ট এসবই ঠিক করেছে। আমাদের তুলনায় তাদের পুরানো পর্যটন স্পট অনেক কম। কিন্তু পর্যটক অনেক বেশি। যদিও ভিয়েতনামের ইতিহাস ২৭০০ বছরেরও পুরনো, তারপরও যে কাজ করেছে, গুছিয়ে করেছে। ভিয়েতনাম নিয়ে আগেও কিছু লিখেছি বলে পুনরায় লেখার সময় নেই। আমি যা দেখি, কয়েক হাজার বছর পুরানো একটা সংস্কৃতি যা অনেক ভাঙ্গাগড়ায় গেলেও তারা কখনো অতীতমুখী রাজনীতি নিয়ে পরে থাকেনি। প্রতিবার পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা হাতে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেছে। আমরা যখন তর্ক করি স্বাধীনতার ঘোষক বা পাঠক নিয়ে। কে শিবিরের রাজনীতি করে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ক্ষুদ্রঋণের প্রবর্তন করে, তখন ভিয়েতনামের অবস্থান একেবার অন্য রকম। তাদের রাজনীতি দেখেন, বাকিটা পরিষ্কার হবে। সংসদে ৫০০ আসনের ৯০ শতাংশ কমিউনিস্ট পার্টি অফ ভিয়েতনামের হাতে। বাকি ১০ শতাংশ ভোট হয়।
গত নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ৯৯.৬০ ভাগ। সাত কোটি লোক ভোট দেয়, যদিও জানে সিপিভি জয়ী হবে। কারণ হলো ভোট মানে জনসমর্থনের পরীক্ষা নয়, বরং তাদের ভোটের মূল লক্ষ্য দুইটা- তথ্য সংগ্রহ করা এবং দলের কর্মী ও শক্তিবৃদ্ধি করা। বর্তমান সংসদে সিপিভির ৪৫০ আসনের বাইরেও অতিরিক্ত ৩৫ সীট তাদের হাতে, বাকি ১৫টা অন্য দলের। শেষ কবে শুনেছেন ভিয়েতনামে কোনো রাজনৈতিক বা ছাত্র আন্দোলন বা শ্রমিক আন্দোলন হয়েছে? আমার দেখা কয়েক বছরের ইতিহাসে একবার ছাত্র আন্দোলন হয়েছিলো আবহাওয়া নিয়ে, আর বছর বিশ আগে ভোটার বয়স ১৮ থেকে ১৬ করার এক আন্দোলন হয় যা সরকার মেনে নেয়। পোশাকশিল্পে আন্দোলন দেখা যায়নি, তারা অল্পে সন্তুষ্ট জাতি। তাদের কোনো অলিগার্কি সরকারের পিছনে পাহারা দেয় না, বরং পলিটব্যুরো দেশ পরিচালনায় সাহায্য করে। ক্ষমতাধর ব্যক্তি হাতে গোনা পাঁচজন, পার্টি প্রধান, পার্টির সাধারণ সম্পাদক, প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী।
যে দেশ যেভাবে চলে অভ্যস্ত তা সেভাবে চলবে। ভিয়েতনামের সাফল্যের বড় কারণ তারা ইনভেস্টমেন্টের দরজা খুলে দেয় ১৯৯৯-২০০০ সালের দিকে, সে দরজা এতোই বিনিয়োগবান্ধব ছিলো যে আমেরিকান ও ইউরোপিয়ান কোম্পানি বড় বিনিয়োগ নিয়ে চলে আসে। শুরুতে শর্ত ছিলো মালিকানার সামান্য অংশ ভিয়েতনাম সরকারের থাকবে যেন সেসব কোম্পানি চলে গেলেও সরকার তা চালাতে পারে। পরে যখন মাল্টি ন্যাশনাল নিজস্ব অফিস ও ফ্যাক্টরি খোলে, সে আইনও বদলে দেওয়া হয়। আরও কারণের মধ্যে, তাদের মধ্যে বেসিক সততা আছে, জনগণ খাটতে পরে, মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য অল্প আয়েও অসন্তুষ্ট না, টাকা বাইরে পাচার হয় না, শিক্ষা ব্যবস্থা সবসময় আপডেটেড থাকে, টেকনোলজিকাল সাবজেক্টে জোর দেওয়া হয়, সবার উচ্চ শিক্ষায় সময় নষ্ট হয় না, কৃষিখাতে উদ্বৃত্ত থাকে, জমির সুষম ব্যবহার করে, সোলার ও উইন্ড পাওয়ারে যথেষ্ঠ এগিয়ে আছে, অর্থনীতি বিশেষ করে রপ্তানিতে কখনো সময় নষ্ট হয় না, কোনো ছাত্র বা শ্রমিক সংগঠন বা আন্দোলন নেই, ধর্মীয় গোঁড়ামি নেই এবং চীনের সঙ্গে বর্ডার থাকায় চীনের অনেক পণ্যের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজের কাজ হাতে পায়। ভিয়েতনাম কোনো বিদেশি প্রভুরাষ্ট্র নীতিতে চলে না, যা সম্পর্ক, সবই ব্যবসায়িক। চীন ও আমেরিকার মধ্যে ব্যালান্স করে চলে। বাংলাদেশকে ভিয়েতনাম হতে গেলে অন্তত দুইটা কাজে হাত দিতে হবে, গিনি ইনডেক্স আমাদের খারাপের দিকে ৫০ শতাংশ, তাদের ৩৫ শতাংশ, সেখানে অর্থের মালিকানার বৈষম্য কমাতে হবে এবং এইচডিআই ইনডেক্স ভালো করতে হবে, সেখানে গড় আয়ু, শিক্ষা ও মাথাপিছু আয় হিসাব করা হয়। লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক
