
কে কীভাবে টাকা উপার্জন করে, তার চেয়ে কে কীভাবে খরচ করে; তা দিয়ে তাকে বেশি চেনা যায়

ড. কামরুল হাসান মামুন
যেদিন শুনলাম, সাদেক এগ্রো গরু-ছাগলের মধ্যেও বর্ণপ্রথা ঢুকিয়ে দিয়ে গরু ছাগলকে উচ্চবংশীয়, নিম্নবংশীয় হিসেবে দেখিয়ে উচ্চ মূল্যে বিক্রি করছে সেদিনই বুঝে গিয়েছিলাম এই লোক আস্ত ধান্দাবাজ। এই প্রাণিদের বাপ-দাদা, পরদাদার নাম পরিচয় দিয়ে গরুদের মধ্যে বংশীয় বিভাজন এনে কোটি টাকায় গরু আর ১৫ লাখ টাকায় ছাগল বিক্রি করেছে। পৃথিবীতে গরুর বাজারে এমন বিভাজন কেউ কখনো কোথাও শুনেছে আমি তখন মনে মনে ভাবছিলাম আচ্ছা একটি গরুর দাম কী করে ১ কোটি টাকা হয় আর একটি ছাগলের দাম কী করে ১৫ লাখ টাকা চায় আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই দাম দিয়ে গরু ছাগল কেনার ক্রেতা এই দেশে আছে। কল্পনা করা যায়
এই দামে গরু ছাগল মানুষ তখনই কিনতে পারে যখন মানুষ তাদের অর্থসম্পদ ও টাকাপয়সা কষ্ট করে অর্জন না করে মেগা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করে। সাদেক এগ্রোর ব্যবসা কোনো না কোনোভাবে কালো টাকা সাদা করার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। কয়েকদিন আগে অমিতাভ বচ্চন ও জে ডি টাটার একই প্লেনে ভ্রমণের একটি গল্প পড়ছিলাম। অমিতাভ বচ্চন তখন ক্যারিয়ারের তুঙ্গে। একদিন প্লেনে করে যাচ্ছিলেন। খুব সাধারণ শার্ট আর প্যান্ট পরিহিত একজন ভদ্রলোক তার পাশে বসেই যাচ্ছিলেন। দেখে উনাকে একজন শিক্ষিত এবং মার্জিত মধ্যবিত্ত মানুষ মনে হয়েছিলো। অন্য সহযাত্রীরা অমিতাভকে চিনতে পেরে খুব উৎসাহিত হয়ে অটোগ্রাফ নিচ্ছে। কিন্তু পাশে বসা ভদ্রলোকের তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিলো না। উনি এক মনে একটা খবরের কাগজ পড়ছিলেন, আর মাঝে মাঝে জানালার বাইরে তাকিয়ে কী যেন ভাবছিলেন। চা পরিবেশন করা হলো, ঠোঁটের আগেই থ্যাঙ্কস লেগেই আছে। অমিতাভকে পাত্তাই দিচ্ছে না।
অমিতাভের উনার প্রতি কৌতুহল বেড়েই চলছিলো। তাই উনার সঙ্গে কথা বলার জন্য উনার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। উনিও একটা সৌজন্যমূলক হাসি ফিরিয়ে দিয়ে বললেন ‘হ্যালো’, এরপর কিছু সৌজন্যমূলক কথোপকথন শুরু হলো। একসময় অমিতাভ নিজে থেকেই সিনেমা প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন (আমি যেমন করি। কোথাও গেলে এক্সট্রা খাতির পেতে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সেটা বলার মওকা একদম ছাড়ি না)। অমিতাভ বচ্চন জিজ্ঞাসা করলেন: আপনি সিনেমা দেখেন উনি বললেন: কখনো-সখনো, শেষ যে সিনেমাটা দেখেছি, তাও প্রায় এক বছরের বেশি হয়ে গেছে।’ অমিতাভ: আমি ওই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেই আছি। উনি উৎসাহিত হয়ে বললেন: দারুণ ব্যাপার। তা আপনি কী করেন: অমিতাভ খুব উৎসাহের সঙ্গে বললেন যে আমি একজন অভিনেতা। প্রত্যুত্তরে বললেন: দারুণ। ব্যাস! ওই পর্যন্তই। প্লেন ল্যান্ড করার পর অমিতাভ বচ্চন ভদ্রলোকের দিকে করমর্দনের জন্য হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন: আমার নাম অমিতাভ বচ্চন। উনি মাথানত করে আমার হাতটা ঝাঁকিয়ে দিয়ে বললেন: আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়ে দারুণ লাগলো। আমার নাম জে.আর.ডি. টাটা (ঔবযধহমরৎ জধঃধহলর উধফধনযড়ু ঞধঃধ, পযধরৎসধহ ড়ভ ঞঅঞঅ এৎড়ঁঢ়) চমকে উঠলাম আমি। এই ঘটনা থেকে শেখার যেটা আছে সেটা হলো: অমিতাভ তো বড়ই হন না কেন, তার থেকেও বড় কেউ আছেন। কিন্তু তাঁর দৃষ্টিটা সর্বদাই মাটির দিকে।
কিন্তু আমাদের দেশের ধনীরা কোরবানির গরু কিনতে গিয়ে প্রতিযোগিতায় নামে। কতো দামের গরু কেনা যায় যেন মানুষ জানে তার টাকা হয়েছে। আমাদের দেশের ধনীরা রিসোর্ট বানায়, বাগান বাড়ি বানায় যেন সবাই জানে যে তার অনেক টাকা। আমাদের দেশের ধনীদের ফুটানির অভাব নেই। টাটা কী করেছে গত পরশুও দেখলাম টাটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মৃতপ্রায় একটি কুকুরের জন্য রক্ত চেয়ে মানুষের কাছে আহ্বান জানিয়েছে। টাটা টাকা খরচ করে মানুষের চাকুরি তৈরির জন্য। তারা বিদেশে পাচারের জন্য, সুইস ব্যাংকে টাকা ঘুম পারাবার জন্য টাকা পাচার করে না। টাটা শিক্ষা ও গবেষণার জন্য প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করে, মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের জন্য অর্থ বিনিয়োগ করে। তারা শত কোটি টাকা দামের গাড়িতে চড়ে না।
কে কীভাবে টাকা উপার্জন করে, তার চেয়ে কে কীভাবে খরচ করে তা দিয়ে তাকে বেশি চেনা যায়। ওই যে ১ কোটি বা ৫০ লাখ টাকা দিয়ে যারা গরু কিনে কোরবানি দিয়েছে তাদের অর্থ উপার্জনের উৎস খুঁজে দেখেন। দেখবেন এরা দুর্নীতি আর ধান্দাবাজির মাধ্যমে উপার্জন করেছে। এরা এই সব টাকা দিয়ে দামি গরু কোরবানি দিবে, বছর বছর হজ্ব করতে যাবে, মসজিদে দান করে মসজিদ কমিটির সভাপতি হবে। এদেরকে কখনো শিক্ষায় বা মানুষের কল্যানে অর্থ খরচ করতে দেখবেন না। এই বছর বোস-আইনস্টাইন তত্ত্বের ১০০ বছর পূর্তি হতে যাচ্ছে। পৃথিবীর প্রায় কেউই জানে না যে এই তত্ত্বের জন্মস্থান বাংলাদেশ। এইটা জানাতেও আমরা ব্যর্থ হয়েছি। আর ব্যর্থ হতে চাই না। তাই নভেম্বরে ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে একটা কনফারেন্স করছি। বিশ্বের অনেক দেশের অনেক বড় বড় বিজ্ঞানী ইতিমধ্যে বাংলাদেশে আসবে বলে জানিয়েছে। সমস্যা হলো এর জন্য টাকা জোগাড় করতে পারছি না। এত বড় একটা মহৎ কাজে কারো উৎসাহ দেখিনা। আছেন কেউ দিবেন লেখক: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
