
কুপার রহস্য
স্বপন ভট্টাচার্য্য
২৪ নভেম্বর ১৯৭১, বেলা ২-৫০ মিনিট ওরেগনের পোর্টল্যান্ড বিমানবন্দর থেকে উড়ল একটি বোয়িং ৭২৭-১০০ বিমান। উত্তর-পশ্চিম ওরিয়েন্ট এয়ারলাইন্সের বিমান, ফ্লাইট নম্বর ৩০৫। গন্তব্য ওয়াশিংটনের সিয়াটেল বিমানবন্দর। আবহাওয়া পরিষ্কার, যাত্রীও বেশি নেই। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছেন মাত্র বিয়াল্লিশ জন। পোর্টল্যান্ড থেকে সিয়াটেল এটুকু দূরত্ব অতিক্রম করতে সময় লাগে মাত্র পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ মিনিট। কিন্তু দুই ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও বিমান ল্যান্ড করলো না কেন যাত্রীরা উদ্বিগ্ন। এমন সময় ঘোষণা হলো যে সামান্য কিছু যান্ত্রিক গোলোযোগের জন্য বিমানটি অবতরণে সমস্যা হচ্ছে। যাত্রীরা যেন উদ্বিগ্ন না হন। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমানটি অবতরণে সক্ষম হবে।
বিমানটির দরজা বন্ধ হবার অল্প আগে বিমানে প্রবেশ করলেন প্রায় ছয় ফুট লম্বা মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক। তাঁর পরনে গাঢ রঙের স্যুট, সাদা কলারের শার্ট, কালো টাই তাতে মুক্তো বসানো টাই-পিন। গায়ের ওপর একটা বর্ষাতি। হাতে ব্রিফকেস। ভদ্রলোক বিমানে উঠেই খাওয়াদাওয়া সারলেন। তারপর বিমান ছাড়ার একটু পরেই সিট থেকে উঠে গিয়ে ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ট ফ্লোরেন্স শ্যাফনারের হাতে একটা কাগজ দিয়ে এসে নিজের সিটে বসে পড়লেন। বহু যাত্রীই শুধু শ্যাফনারের সঙ্গ পাওয়ার আশায় এভাবে চিরকুটে নাম, ঠিকানা ও টেলিফোন নাম্বার লিখে দিয়ে যান। তাই শ্যাফনার বিশেষ পাত্তা না দিয়ে কাগজটা না পড়েই ব্যাগে রেখে দিলেন। নিজের সিটে বসে ভদ্রলোক লক্ষ করলেন যে ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ট কাগজটা পড়েননি। তিনি এবার সিট ছেড়ে উঠে গিয়ে ফিসফিস করে বললেন, মিস, আপনি কাগজটা একবার খুলে দেখলে ভালো হয়।
আমার কাছে বোমা আছে। সঙ্গে সঙ্গে শ্যাফনারের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। ভদ্রলোক আবার বললেন, আমার ব্রিফকেসে বোমা আছে। দরকার হলে আমি তা ব্যবহার করব। আমি চাই তুমি আমার পাশে এসে বসে পড়বে। তোমাদের হাইজ্যাক করা হয়েছে। ভদ্রলোক তো একথা বলেই নিজের সিটে গিয়ে বসলেন। শ্যাফনার প্রচণ্ড ভীত হয়ে আর একজন ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ট টিনা মাকলৌকে সঙ্গে নিয়ে ভদ্রলোকের পাশে বসে পড়লেন। ভদ্রলোক ব্রিফকেস খুলে দেখালেন যে তার মধ্যে কয়েকটা লাল রঙের বল রয়েছে যেগুলো তার দিয়ে জোড়া। ভদ্রলোক বললেন যে তাঁর ২০০,০০০ ডলার চাই। চারটে প্যারাস্যুট চাই। আগে থাকতে সিয়াটেল বিমানবন্দরে রি-ফুয়েলিংয়ের ব্যবস্থা করে রাখতে হবে। আর এই ব্যবস্থাগুলো না হওয়া পর্যন্ত বিমান ল্যান্ড করানো যাবে না। তিনি একজন ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্টকে নিজের পাশে বসিয়ে অন্যজনকে ককপিটে পাঠিয়ে দিলেন পাইলটের কাছে তাঁর দাবি জানাতে।
পাইলট উইলিয়াম স্কট সব শুনে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সঙ্গে যোগাযোগ করে হাইজ্যাকারের দাবির কথা জানিয়ে দিলেন। ৫টা ২৪ মিনিটে খবর এল সব ব্যবস্থা করা হয়েছে। সব শুনে তিনি নির্দেশ দিলেন কেবিনের সব লাইট নিভিয়ে দিতে হবে আর চারপাশ উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত কোনও অঞ্চলে বিমান নামাতে হবে। ততক্ষণ পর্যন্ত বিমানটি সিয়াটেলের আকাশে চক্কর কেটেই চলেছে। অবশেষে ৫টা ৩৯ মিনিটে বিমানটি অবতরণ করল সিয়াটেল বিমানবন্দরে। পাইলট স্কট, কো-পাইলট র্যাটাচজ্যাক, ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ট টিনা মাকলৌ, আল লী এবং ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার এইচ.ই.অ্যান্ডারসন ছাড়া আর সকলকে তিনি বিমান থেকে নেমে যাবার অনুমতি দিলেন। একচল্লিশজন যাত্রী বিমান থেকে নেমে যাবার সময় ঘূণাক্ষরেও বুঝতে পারলেন না যে কী মারাত্মক বিপদের মুখোমুখি হয়েছিলেন তাঁরা। তাঁরা শুধু লক্ষ করলেন যে বিমানবন্দরে কিছু অস্বাভাবিক দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে।
যাত্রীরা নেমে যাবার পর টাকার থলি আর প্যারাস্যুট নিয়ে উঠে পড়লেন এয়ারপোর্টের একজন কর্মচারী। তিনি ব্যাগ আর প্যারাস্যুট নামিয়ে তাকে নেমে যাবার নির্দেশ দিলেন। ওই কর্মী নেমে যাওয়ার পর তিনি মুক্তিপণের টাকার ব্যাগ এবং প্যারাস্যুট চেক করে পাইলটকে দক্ষিণ পূর্ব মেক্সিকোর দিকে উড়ে যেতে বললেন। সিয়িটেল থেকে জ্বালানি ভরে সন্ধে ৭টা ৪০ মিনিটে আবার শুরু হল ওই বিমানের উড়ান। তিনি আরও বললেন যে বিমানের গতিবেগ যেন ঘণ্টায় ২০০ মাইলের বেশি না হয়। আর সেই সঙ্গে ল্যান্ডিং গিয়ার খোলা রাখতে হবে, উইং ফ্ল্যাপ ১৫ নামিয়ে রাখতে হবে এবং পিছনের দরজা আন-লক করে রাখতে হবে। পাইলট বুঝে গেলেন যে হাইজ্যাকার বিমানের খুঁটিনাটি জানেন। কিন্তু এভাবে চালালে তো এই জ্বালানিতে মেক্সিকো পর্যন্ত ওড়া যাবে না। ভদ্রলোক বললেন, ঠিক আছে, নেভেদার রেনো বিমানবন্দরে আবার জ্বালানি ভরার ব্যবস্থা করে রাখুন। আর তিনি টিনা মাকলৌকে নির্দেশ দিলেন সে যেন ককপিটের ভিতরে ঢুকে ককপিটের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দেয়। অন্য কোনও উপায় না থাকায় তাঁর কথাই মেনে নেওয়া হল।
এদিকে এফবিআই-ও বসে ছিল না। তারা খবর নিয়েছে যে ওই ভদ্রলোকের টিকিট কাটা হয়েছে ড্যান কুপারের নামে (অবশ্য জনৈক সাংবাদিকের ভুলে পরবর্তী সময় সারা বিশ্বে তিনি ডি. বি. কুপার নামেই পরিচিত হয়ে যান)। ব্যাংক থেকে যে ডলারের নোটগুলো তাকে দেওয়া হয়েছিল সেগুলো খ ১৯৬৩ অ এবং খ ১৯৬৯ সিরিজের। সেই নোটগুলোর নম্বর দিকে দিকে প্রচার করে দেওয়া হল যাতে ওই নোটগুলো কেউ ভাঙালেই পুলিশ হাইজ্যাকারের সন্ধান পেয়ে যায়। ওই বিমানের দৃষ্টিসীমার বাইরে দিয়ে আরও বিমান (এফ ১০৬ ফাইটার প্লেন) উড়তে শুরু করল ওই বিমানটিকে ঘিরে।
যথাসময়ে বিমানটি অবতরণ করল রেনো বিমানবন্দরে। জ্বালানি ভরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর মোতায়েন রয়েছে প্রচুর সংখ্যক পুলিশ। একটু সুযোগ পেলেই হাইজ্যাকারকে নিশ্চিতভাবেই পাকড়াও করা হবে। ককপিটের ভিতরের লোকেরা এবং বিমানের বাইরে বহু মানুষ রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে। এর মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ কেটে গিয়েছে। কিন্তু কোথায় কারো তো কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। অবশ্য বিমানে হাওয়ার চাপ পরিমাপ করে পাইলট আগেই অনুমান করেছিলেন যে পিছনের দরজাটা খোলা রয়েছে। তবে হাইজ্যাকার যে সেখান থেকে ঝাঁপ দিয়েছে তা আন্দাজ করতে পারেননি। ককপিটের ভিতর থেকে ওয়াকিটকিতে হাইজ্যাকারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হল। এরই মধ্যে একজন সাহস করে ককপিটের বাইরে এসে দেখল কেউ কোত্থাও নেই। একটা প্যারাস্যুট আর টাকার ব্যাগও নেই। পড়ে আছে অন্য প্যারাস্যুটগুলো এবং টাইটা। যেখানে হাওয়ার চাপে তারতম্য হয়েছে বলে পাইলটের মনে হয়েছে সেই জায়গাটা ঘন জঙ্গলাকীর্ণ। সেখান থেকে কিছু খুঁজে পাওয়া আর খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজা একই ব্যাপার। তবুও এফবিআই চেষ্টার কসুর করল না। শুধু ওই জায়গাটুকুই নয় যে অঞ্চলের উপর দিয়ে বিমানটি সিয়াটেল থেকে রেনোর দিকে এসেছে সেই সমস্ত জায়গা তন্নতন্ন করে খোঁজা হল। কিন্তু না, ড্যান কুপারের কোনও সন্ধানই পাওয়া গেল না। লোকটা যেন কর্পুরের মতো উবে গিয়েছে। তাছাড়া ওই নোটগুলোরও তো কোনও খোঁজ পাওয়া গেল না।
এর প্রায় নয় বছর পর ১৯৮০ সালে এক বালক কলম্বিয়া নদীর তীরে পিকনিক করতে গিয়ে ৫৮০০ ডলার কুড়িয়ে পায় যা একটা জায়গায় পোঁতা ছিল। যে নোটগুলোর নম্বর হাইজ্যাকারকে দেওয়া নোটের নম্বরের সঙ্গে মিলে যায়। কিন্তু গোয়েন্দারা কিছুতেই বুঝতে পারে না যে অত দূরে ওই নোটগুলো গেল কীভাবে তাহলে কি এফবিআই-কে বিভ্রান্ত করতেই ওই ডলার ওখানে রাখা ছিল আর তাও সামান্য কয়েকটি নোট। বাকি নোটের কী হল এর অনেক পরে মারলা কুপার নামের এক মহিলা জানান যে তাঁর যখন আট বছর বয়স তখন তাঁর দুই কাকাকে তিনি কিছু সন্দেহজনক পরামর্শ করতে দেখেছিলেন এবং বিমান হাইজ্যাকের পরদিন রক্তাক্ত অবস্থায় তাঁর এক কাকাকে বাড়ি ফিরতে দেখেছিলেন।
শোনা যায় তিনি গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিলেন। তাঁর সেই কাকা ১৯৯৯ সালে মারা যান। যদিও গোয়েন্দারা এই ঘটনার কোনও সত্যতা খুঁজে পায়নি। কোনও দিক থেকে কোনও সূত্র না পেয়ে অবশেষে মার্কিন গোয়েন্দা বাহিনী ২০১৬ সালে এই তদন্ত সরকারিভাবে বন্ধ করে দেওয়া হল বলে ঘোষণা করে। আজ পর্যন্ত বিশ্বে এটাই একমাত্র অমীমাংসিত বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা যার কোনও হদিসই গোয়েন্দারা পায়নি। তবে এফবিআই সরকারিভাবে তদন্ত বন্ধ করে দিলেও এরিখ উলিস নামের একজন প্রাইভেট গোয়েন্দা তাঁর মতো করে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছিলেন। অতি সম্প্রতি দাবি করেছেন যে তিনি ওই বিমানে পাওয়া টাইপিনে যে টাইটানিয়াম এবং একটি বিশেষ ধরনের স্টিল পাওয়া গিয়েছে তা ব্যবহার করত অধুনা বন্ধ হয়ে যাওয়া পেনসিলভানিয়ার একটি স্টিল কোম্পানির মেটালারজিস্টরা। যে কোম্পানিটি বোয়িং বিমান প্রস্তুতকারকদের বিভিন্ন পার্টস সাপ্লাই করত। ওই স্টিল কোম্পানিতে কর্মরত ছিলেন ভিন্স পিটারসেন। যাঁর উচ্চতা ছিল ছয় ফুট এবং যাঁর চেহারার সঙ্গেও প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী আঁকা ড্যান কুপারের ছবির সঙ্গে কিছুটা মিলে যায়। তিনি আরও দাবি করেছেন যে তিনি ওই পরিত্যক্ত টাই থেকে একটা ডিএনএ নমুনা পেয়েছেন। এছাড়াও ১৯৬১ সালের একটা এনভেলপ উলিস সংগ্রহ করেছেন পিটারসেনের পরিবারের কাছ থেকে। এখন যদি এফবিআই ওই পরিত্যক্ত টাই তার গবেষণার জন্য দেয় তবে তিনি নিশ্চিতভাবেই এই রহস্যের সমাধান করে ফেলবেন। যদিও আদালত এফবিআইকে ওই টাই উলিসকে দেবার নির্দেশ দিতে অস্বীকার করেছে। প্রসঙ্গত ২০০২ সালে পিটারসেন মারা গিয়েছেন। এফবিআই আবার নতুন করে তদন্ত শুরু করে কিনা আর সেই তদন্তে এরিখ উলিসের সাহায্য নেয় কিনা সেটাই এখন দেখার। তথ্যসূত্র: ইন্টারনেটের সৌজন্যে। ২৬-৬-২৪। ফেসবুক থেকে
