
ইসলামের উৎপত্তি ও বিকাশ : একটি মার্ক্সীয় অধ্যয়ন
সিরাজুল ইসলাম : ইসলাম এক আদর্শিক-সামাজিক আন্দোলন। আদর্শ গড়ে ওঠে মত, পথ, ধারণা, বিশ্বাস, প্রতীক, রূপক, কিংবদন্তি, পৌরাণিকী ইত্যাদি নানা উপাদানের সমন্বয়ে। আর সামাজিক আন্দোলন দানা বেধে ওঠে বিশেষ ভাবধারায় অনুপ্রাণিত কোন শ্রেণী বা বৃহৎ দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে। সবকিছুর মতো আদর্শকেও বিশ্লেষণ করতে হয় সতর্কভাবে। বিশেষত ধর্মাদর্শকে। আবেগের প্রাচুর্যবশত অস্বচ্ছতার সম্ভাবনাও বেশী এখানেই। ফলে বহুযুগের ব্যত্যয় ও বিচ্যুতির সাথে সাথে তাতে পরিবর্তন ও পরিবর্ধনগুলো বেড়ে চলে। এছাড়া ভিন্ন দেশকালে সংঘটিত বিশেষ সামাজিক আন্দোলন ও সংশ্লিষ্ট ঘটনাপ্রবাহকে মানুষ প্রায়শ তাদের সঠিক স্বরূপে উপলব্ধি করতে পারে না। পটভূমির ভিন্নতায় কষ্টকল্পনায় বিভ্রান্ত হয়ে থাকে দৃষ্টি। তথ্যাল্পতা ও অনুমান ভারাক্রান্ত এই কল্পতরুর মূল অনেকক্ষেত্রেই বাস্তবে প্রোথিত থাকে না।
উৎপত্তি ও বিকাশের বিচারে যেকোন ধর্মাদর্শের ন্যায় ইসলামও নিশ্চয় একটা প্রাকৃতিক ঘটনা। একটা ধর্মাদর্শ দেশকালের পরিবর্তনের সাথেসাথে যতবেশী তার উৎপত্তিকালীন পটভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, শাসক ও যাজকশ্র্রেণীর স্বার্থপর হস্তক্ষেপের পাশাপাশি অজ্ঞ অনুসারীদের ভক্তি-আবেগের প্রাচুর্যবশত তত তা নানাপ্রকার অশিক্ষায়-কুশিক্ষায় বিকৃত ও অতীন্দ্রিয়বাদে রহস্যাবৃত হয়ে ওঠে। তাই যেকোন আদর্শকে তার জন্মকালীন আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক পূর্বাপর পরিবেশ-পরিস্থিতি তথা আদি পটভূমিসহ পরীক্ষা করে দেখা না গেলে তাকে সঠিকভাবে বোঝা যায়না। ইসলামের ক্ষেত্রেও তাই। বিচিত্র অপরীক্ষিত ধারণাবিশ্বাস ও অন্ধ ভক্তি-আবেগের ধূম্রজালে আচ্ছন্ন প্রথাগত ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি। সরলতাবশত তা তার অনির্ভরযোগ্য অবরোহণমূলক যুক্তি দিয়ে ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর জটিলতাকে যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেনা। এক্ষেত্রে প্রয়োজন সদাজিজ্ঞাসু সদাঅতৃপ্ত আরোহণমূলক পদ্ধতিতে নিরপেক্ষ বৈজ্ঞানিক গবেষণা। প্রয়োজন মার্ক্সীয় অধ্যয়ন। ইতিহাসের এধরনের বিশ্লেষণী অধ্যয়নের সূত্রপাত হয় মার্ক্সের অনেক আগে, আরব ঐতিহাসিকদের লেখায়। নবম থেকে চতুর্দশ শতাব্দি সময়কালের এ প্রবণতার প্রকটতম উদাহরণ স্পেনের শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক ও আধুনিক ইতিহাসের জনক ইবনে খালদুন। যিনি ইতিহাস গবেষণায় দ্বান্দ্বিকতা ও বিবর্তনবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে পরিচিত তাঁর ‘মুকাদ্দিমা’য় তিনি মার্ক্সের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী ধাঁচে ইতিহাসের গতিপথের উপর আলোকপাত করেন। একটা দেশের আর্থসামাজিক, ভৌগলিক, নৃতাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য সবকিছুই ইতিহাসের বিকাশধারাকে নিয়ন্ত্রণ করে, তা তিনিই প্রথম গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে দেখান।
আদর্শ ও ইতিহাস অধ্যয়নের জন্য প্রয়োজনীয় যে মার্ক্সীয় চিন্তাপদ্ধতির কথা আমরা বলছি, তার দুই ভিত্তি। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের মতে, বিপরীতের ঐক্য ও দ্বন্দ্বের সংশ্লেষ থেকে ঘটনার পরিবর্তন হয়; পরিমাণগত পরিবর্তন জমা হতে হতে গুণগত পরিবর্তনে ঝাঁপ দেয়; এবং নেতির নেতিকরণ তথা অস্বীকৃতির অস্বীকৃতির মধ্য দিয়ে নতুন ঘটনাগুলো ক্রমাগত নতুনতর ঘটনাস্রোতের উদ্ভব ঘটায়। এভাবে যেকোন প্রক্রিয়াই প্রস্তাবনা-বৈপরীত্য-সমন্বয় এই দ্বান্দ্বিক যুক্তিধারা অনুসরণ করে ক্রমবিকাশ লাভ করে। পুরনো থেকে বর্জন, নতুন থেকে অর্জন এবং পুরনো-নতুন মিলিয়ে একধরনের নব্যসৃজন তার বৈশিষ্ট্য।
অন্যদিকে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শনের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সংস্করণ। সমাজে মানুষ বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত, যার ভিত্তি ব্যক্তিমালিকানা। উৎপাদনের উপায় তথা ভূমি ও পুঁজির সাথে মানুষের সম্পর্ক তার এই শ্রেণীঅবস্থানকে নির্ধারণ করে। এই শ্রেণীদের পারস্পরিক লড়াই ইতিহাসের চির-আবর্তনশীল চক্রের প্রধান চালিকাশক্তি। তাই মানবজাতির ইতিহাস শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস। এছাড়া উৎপাদন ব্যবস্থা বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হ’ল অবকাঠামো, যে ভিত্তির উপর নির্ভর ক’রে গড়ে ওঠে সমস্ত সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা বা উপরিকাঠামো। অর্থাৎ উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্ব থেকে সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামোয় যে পরিবর্তন হয়, তার সাথে সাথে পরিবর্তিত হতে থাকে সমাজ, সংসার, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও ধর্ম সহ মানুষের সামগ্রিক চিন্তাচেতনা।
তাহলে ধর্ম ও এজাতীয় আদর্শগুলো একপ্রকার উপরিকাঠামো। এবং উপরিকাঠামোকে বুঝতে ও ব্যাখ্যা করতে হয় তার অবকাঠামো তথা আর্থ-সামাজিক ভিত্তি দিয়ে। তবে এই আর্থিক ভিত্তি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে যোগাযোগটা সর্বদা প্রত্যক্ষ না। মাঝখানে প্রায়শ মধ্যস্থতাকারী একটা জটা-জটিল প্রক্রিয়া অলক্ষ্যে বসে কাজ করে, যা প্রায়শ অনুদঘাটিত থেকে যায়।
এভাবে মার্ক্স আদর্শের শিকড় ঐতিহাসিক-সামাজিক পরিবেশ-পরিস্থিতির ভিতর খুঁজে পাওয়া যায় দেখিয়েছেন। যদিও ধর্মীয় ভাববাদকে তাঁর কাছে মনে হয়েছে যেন বাস্তবের বিকৃত উল্টানো প্রতিচ্ছায়া। অবশ্য একইসাথে মার্ক্সবাদের যান্ত্রিক প্রয়োগের বিপদ সম্পর্কেও সচেতন থাকা প্রয়োজন। যেমন, কিছু কট্টর মার্ক্সবাদী লেখক ইসলামের উৎপত্তিকে সামন্ত উৎপাদনসম্পর্কের সাথে সংশ্লিষ্ট করে ভুল করেন। ইসলামের উদ্ভব সামন্তসমাজে হয়নি, হয়েছে মক্কার রমরমা বাণিজ্যিক নাগরিক পরিবেশে। একটি আর্থসামাজিক ক্রান্তিলগ্নে – যেসময়ে লেনদেন ও অর্থপ্রাচুর্যের এক আন্তর্জাতিক কেন্দ্র মক্কা। তখন সেখানে উৎপাদনব্যবস্থা বা উৎপাদনসম্পর্ক সামন্তবাদী ছিলনা। এমনকি সামন্তবাদ বহুদূর থেকেও দৃষ্টিগোচর ছিলনা তদানীন্তন আরবের বেদুইন সমাজেও। মার্ক্সবাদের এধরনের যান্ত্রিক প্রয়োগের বিপদ সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন স্বয়ং এঙ্গেলস।
আদর্শকে অধ্যয়নের উপরোক্ত মার্ক্সীয় পদ্ধতি বিবেচনায় রেখে এই সামান্য পুস্তিকাটা লেখা হয়েছে। ইসলামের উৎপত্তি ও বিকাশকে সত্যিকার উপলদ্ধির একটি সীমিত ক্ষুদ্র প্রয়াস এটা। মনে রাখতে হবে, আদর্শ ও ইতিহাস গবেষণার ক্ষেত্রে সত্যিকার গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এই দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি। তা বিজ্ঞানভিত্তিক বলেই মার্ক্সবাদের সত্যিকার জোরও এখানেই। তবে তথ্যাল্পতাবশত মার্ক্সের বা মার্ক্সবাদীদের স্ব স্ব দেশকালে সীমাবদ্ধ ব্যক্তিগত বিভিন্ন উপসংহার আনেকসময় অর্ধসত্য এমনকি ভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা। সবক্ষেত্রে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে, জানাকে আরো-জানার দিকে উম্মুখ করে রাখা। এবং মনকে সদাসর্বদা সম্পূর্ণ খোলা রাখা। ফেসবুক থেকে
