
বিদেশে প্রাইমারি শিক্ষকেরা অন্যতম ধনী হয়, আর আমাদের প্রাথমিক শিক্ষকদের কী অবস্থা?

কাজী এম. মুর্শেদ
বাংলাদেশের শিক্ষা কারিকুলাম থেকে পেশাগত দিক চিন্তা করে এককথায় বলা যায়, বাঙালি কোনো ক্রিয়েটিভিটির পিছনে থাকে না। শিক্ষা বা বাণিজ্যে, মূলত পিছনে থেকে কাজ করায় বিশ্বাসী। এক এক করে কারণ ব্যাখ্যা করি। সহমত হবার দরকার নেই। আপনারা নিজের মতো কাউন্টার লজিক দিতে পারেন। আপনারা হয়তো নর্মাল ডিস্ট্রিবিউশন কার্ভ কথাটা জানেন। যেকোনো আইডিয়ার প্রথম দিককার লোকগুলোকে আমরা ধরি আর্লিবার্ড যারা ট্রেন্ড সেটার ধরেন ৫ শতাংশের মতো। মাঝের অংশে বাড়তে থেকে, সেটা ঊর্ধ্বমুখী যারা বিশ্বাস করা শুরু করে চলে, সেটা ৪৫ শতাংশের মতো। এরপর স্থিতিশীল হবার পর ক্রমেই নীচে নামতে থাকে, সেটা ৪৫ শতাংশের মতো এবং শেষ ৫ শতাংশ আমরা ধরি ল্যাগারস যারা ঠেকায় না পরে আসে না। এটা যেকোনো ব্যাপারে ধরনটা একই রকমের হয়।
বাঙালি সাধারণত স্থিতিশীল হবার আগ পর্যন্ত বিশ্বাস করা শেখে না। কার্ভের শুরুর ৫০ শতাংশে খুঁজে পাবেন না। অন্যভাবে বলি, সরকারি বা কিছু বেসরকারি টেন্ডারে দেখবেন কিছু কেনাকাটা করতে গেলে একই ধরনের অন্য ক্রেতার রেফারেন্স খোজে। আর কে কে কিনেছে, তাদের অভিজ্ঞতা কেমন সেটা নিশ্চিত না হয়ে কিনতে পারে না। অবশ্যই পয়সা বাঁচে, কিন্তু যতোদিন পিছিয়ে যায় তার দাম অনেক। আরো খরচ আছে, বিদেশে জ্ঞানার্জন কাম শপিং করতে হয়, কেনার সময় পরীক্ষা করতে হয়। একবার মনে আছে নিশ্চয়ই কাপড়ের রং কী হবে সেটা দেখতে তিন সদস্যের কমিটি জার্মান যাবার কথা ছিলো। বলা হয়, যেই কেমিকেল দিয়ে রং হবে সেটা পরীক্ষা করতে একটা নন-টেকনিক্যাল টিম জার্মান যাবে। বর্তমানের উদাহরণ সরিয়ে রাখি, লিফ্ট কেনার জন্য যখন বলে ছয় সদস্যের কমিটি লিফ্টের প্লান্ট পরিদর্শনে সুইডেন যাবে, যারা আবার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, তখন কিছু বলার থাকে না।
ক্রিয়েটিভিটি ও ব্যবসা নিয়ে কথা বলছিলাম, আমাদের দেশে যেসব পণ্য তৈরি হয়, তার কতোগুলো ক্রিয়েটিভ? প্রায় সবই কোনো না কোনো সময় অন্য কেউ শুরু করেছে, এরপর আমরা তৈরি করি। একটা সহজ উদাহরণ, ইলেকট্রোলাইট ড্রিংক এসএমসি তৈরি শুরু করে যাতে বয়স হলে শরীরের কেমিকেল ডেফিসিয়েন্সি যেমন সোডিয়াম, পটাশিয়াম, আয়রন এর অভাব দূর করে। যেহেতু বিএসটিআই সনদ নেই, সেটা তুলে ফেলা হলো। অথচ অনেক অপ্রয়োজনীয় ড্রিংক সনদ নিয়ে ব্যাবসা করছে। বিদেশে যখন মিনারেল ওয়াটার, স্পার্কলিং ওয়াটার, পিএইচ বেজড ড্রিংক চলে, আমাদের এখানে এনার্জি ড্রিংক চলে। যেখানে ইলেকট্রোলাইট ড্রিংক হতে পারতো গেম চেঞ্জার, আমাদের বিএসটিআই এর জ্ঞানের অভাবে সেটা বন্ধ করতে হয়। এই আলাওলের পদ্মাবতী লিখা মুখস্ত করা ক্যাডার সার্ভিস যখন বিজ্ঞানের সঙ্গে ব্যবসার নীতিমালা করে, তখন কী আসা করবেন?
অন্য কথায় আসি, বিদেশে কী হয়। একটা উদাহরণ দিই। ফটোগ্রাফিতে নাম করা দুই কোম্পানি ফুজি এবং কোডাক। একটা সময় যখন ডিজিটাল ক্যামেরা আসলো সঙ্গে ভিডিওসহ, ফুজি ধরতে পারলো তাদের ব্যবসা কমে আসবে। তারা তাদের সমস্ত বিজ্ঞানী নিয়ে প্রায় ৫ হাজার ধরনের কেমিকেল নিয়ে বিভিন্ন চিন্তা শুরু করলো। ফলাফল, তারা বিশ্বের নাম করা কিছু পারফিউম তৈরি করে বসলো। সেগুলো যেমন চলে তেমনি বিভিন্ন বড় কোম্পানি যারা শুধু ব্রান্ডিং করে, তাদের কাজ নিয়ে তৈরি করা শুরু করলো। ফুজি টিকে গেলো। অন্যদিকে কোডাক তাদের পূর্ব ঐতিহ্য ধরে রেখে একসময় নাই হয়ে গেলো। তাদের কোডাক সেন্টার ভাড়া দিয়ে গান বাজনা বা খেলাধুলা হয়। এখানেই আর্লিবার্ডদের জয় আসে।
অন্য উদাহরণ দিই, ৫০/৬০ দশকের ছবি দেখেন, পুরুষ মানুষ ক্লিন শেভড থাকতো। আজকাল দেখেন, বড় দাড়ি, ছোট দাড়ি, ট্রিম দাড়ি, খোঁচা দাড়ির অভাব নেই। জিলেট তার বিভিন্ন কাজ সেই শেভিং কিট, ফোম, এসবে সময় দিয়ে গেছে। ফলাফল বিশেষ অঙ্গের চুল ছাড়া এর কাজ কমে গেছে। অন্যদিকে জার্মানের জিলেটের প্রতিবেশী নেদারল্যান্ডের ফিলিপস দেখেন, তারা যখন দেখলো পুরুষ মানুষ অলসতা বা সৌন্দর্য্যরে জন্য দাড়ি কাটা কমিয়ে দিয়েছে, তারা দাড়ি ট্রিম করে সুন্দর রাখার উপর ইনভেস্ট করলো। এখন সম্ভবত জিলেটকে প্রক্টর এ্যান্ড গ্যাম্বল কিনে নিয়েছে। ভবিষ্যৎ দেখতে পারা এবং সেই অনুযায়ী কাজ করাটাই জয়ের মন্ত্র। আমাদের এক প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, সেমি কন্ডাক্টর নীতিমালা করে আমরা ৫০ হাজার মাইক্রো চিপ ডিজাইনার তৈরি করবো। শুনতে ভালো লাগে, রিয়েলিটি হলো এই ৫০ হাজার কোথায় পাবেন? সেই পথে শিক্ষা নেই। পাওয়া গেলেও তারা কোথায় কাজ করবে, কোথায় থাকবে?
এ ধরনের কাজে ক্রিয়েটিভ মানুষের দরকার যারা নিজেদের জন্য যেমন একাকী সময় চায় তেমনি তেমন এলাকা চায় যেখানে একই ধরনের চিন্তা ভাবনার মানুষ থাকে। এদের কোথায় থাকার আর কাজ করার ব্যবস্থা করবেন, তারা তাদের পরিবার নিয়ে কোথায় থাকবে যেখানে স্কুল কলেজ থেকে শুরু করে বাজার সদাই, আড্ডার জায়গা, এন্টারটেইনমেন্টের সব ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে? মাইক্রো চিপ ডিজাইন করে বেচবার জন্য বেশি কষ্ট হবে না, কিন্তু আমাদের সেই ব্রান্ডিং কি আছে? কারা সেগুলো বিপননের কাজ করবে? একটা স্যাটেলাইট পাঠিয়ে যেখানে ২৪টা রিসেপটর আছে, কোন দেশকে একটা রিসেপটর গত ছয় বছরে বেচতে পারেনি, সেখানে বাংলাদেশ ব্রান্ড হিসেবে সিরিয়াসলি ব্যার্থ। মাইকেরো চিপ ডিজাইন করলে হবে না, স্যাম্পল কোথায় বানাবেন বা টেস্ট করবেন? চিপ তৈরির জন্য যে ধরনের ফ্যাসিলিটি লাগে, সেই সিলিকা লাগে এবং যেই ফ্যাব-ল্যাব লাগে, তার কোনোটা কি চিন্তা করে দেখেছেন?
আমরা মূলত ট্রেডিং জাতি। মাল কিনবো এবং বেচবো এটাই আমরা বুঝি। বছর শুরুতে হালখাতা খুলে জমা খরচ ইজা মানে বিক্রি কতো, কেনা কতো, হাতে কতো এটাই পারি। যার কাছে বেচলাম তার জন্য কতো টাকায় বিক্রি, কতো টাকা দিয়েছে আর কতো বাকিÑ এই হলো জমা খরচ ইজার অবস্থা। আমরা ক্রিয়েটিভ না, সেটা বারবার বলার ব্যাপার, বলতেই হবে। ততোক্ষণ বলতে হবে যতোক্ষণ না কিছু কাজ হবে। ভারত যদি ট্রানজিট নেয়, সেখান থেকে আয়ের সুযোগ ছিলো, নেয়নি। ভারত বা চীন বা মালয়েশিয়া যদি ইনভেস্ট করে, ভালোমানের হাসপাতাল তৈরি করুক যেন বিদেশ যেতে না হয়, সেখানে আমরা ভিসা সহজ করে দিই যেন বিদেশ যায়। অনেক দেশ হয়তো দেখি নি, যা দেখেছি বলতে পারি আমাদের পর্যটনের অপার সম্ভাবনা কারণ প্রকৃতিগতভাবে এবং বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কালচার থেকে আমরা আসছি। নেপালের সেই তুলনায় প্রায় কিছুই নেই, শ্রীলংকা বা মালদ্বীপেরও নেই, ভূটানের একদমই নেই। অথচ তারা পারছে। আমরা পারি না। কারণ সেই নর্মাল ডিসট্রিবিউশন কার্ভের শেষের অর্ধেকে থাকি। আর কয়দিন পর যদি বিসিএসে দেখেন যেকোনো দেশের নাগরিক পরীক্ষা দিতে পারবে, অবাক হবেন না। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ঠিক নেই। বিদেশে প্রাইমারি শিক্ষকরা অন্যতম ধনী হয়, সেটা কানাডা, ফিনল্যান্ড, জাপান বা সিঙ্গাপুর দেখলে বুঝবেন। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষকরা রীতিমতো যুদ্ধ করে যেন এলাকার চৌকিদারের ২৩০০ টাকার স্কেলের চেয়ে কিছু বেশি বেতন পায়। এখন কি আমার যুক্তি ধরতে পারছেন? না পারলে আপনার যুক্তি শুনতে চাই। লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক
