
বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর কাছে রিজার্ভ থেকে ১২ দশমিক ৭৯ কোটি ডলার বিক্রি

মাসুদ মিয়া: [১] বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর কাছে রিজার্ভ থেকে ১২ দশমিক ৭৯ কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ ডলার সংকটে ভুগতে থাকা ব্যাংকগুলো আমদানি বিল মেটাতে হিমশিম খাচ্ছিল। দেশের বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। এটি সামাল দিতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত (রিজার্ভ) থেকে প্রচুর ডলার বিক্রি করতে হয়েছে। অবশ্য বিক্রির পাশাপাশি একই সময়ে বাণিজ্যিক কিছু ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক এক বিলিয়ন ডলারের মতো অর্থ কিনেও নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, গত আড়াই বছর যাবৎ দেশের ডলার সংকট। অনেক পদক্ষেপ নিয়েও এই সংকট থেকে মুক্তি মেলেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। এমন পরিস্থিতিতে জরুরি পণ্যের আমদানি ব্যয় মেটাতে নিম্নমুখী বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ থেকেই ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও সম্প্রতি রেমিট্যান্সের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা আর বিদেশি কয়েকটি ঋণের কিস্তি মেলায় রিজার্ভে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরেছে।
[২] তথ্য বলছে, সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর কাছে ১২ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে ১ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যা দেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের ওপর বড় ধরনের প্রভাব তৈরি করেছে। এটি দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সবোর্চ্চ ডলার বিক্রির রেকর্ড। এর আগে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিক্রি করা হয়েছিল ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি (বিপিএম৬) অনুযায়ী এ বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত মোট রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২১ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার এবং নিট আন্তর্জাতিক রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ১৬ দশমিক ০৩ বিলিয়ন ডলার।
[৩] কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন ব্যাংকগুলোর জন্য ডলার সহায়তা কমিয়ে দিয়েছে। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোতে এখন ডলারের তারল্য তৈরি হয়েছে, এজন্য তাদের সহায়তা নিতে হয় না। করোনা মহামারির কারণে আরোপিত বিধিনিষেধের মধ্যে আমদানি ব্যয়, আন্তর্জাতিক ভ্রমণ ও অন্যান্য উদ্দেশ্যে বিদেশি মুদ্রার বহিস্থ লেনদেন কমে। বিপরীতে প্রবাসী আয় বাড়ে। ফলে ২০২১ সালের আগস্টে দেশের রিজার্ভ রেকর্ড ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। আমদানি বিল পরিশোধ বাড়তে শুরু করলে ও অর্থনীতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলে রিজার্ভ কমতে শুরু করে। এর মধ্যে ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়। এতে পণ্যের দাম বেড়ে যায় এবং বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার বাজার আরও অস্থির হয়ে ওঠে। ব্যাংকাররা বলছেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে অব্যবস্থাপনা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘন ঘন নীতি পরিবর্তন এবং অফিসিয়াল বিনিময় হার ও অনানুষ্ঠানিক বিনিময় হারের মধ্যে ব্যবধানও ডলারের অস্থিতিশীলতার জন্য দায়ী। ২০২১ সালের আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৪ বিলিয়ন ডলার কমেছে।
[৪]এটি দেশের ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ নয়। দায়দেনা বাদ দিলে দেশের বর্তমান ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ দাঁড়াবে ১৬ দশমিক ০৩ বিলিয়ন ডলার, যা দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরুতে দেশের গ্রস রিজার্ভের ছিল ৩১ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। আর অর্থবছরের শেষে রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ২৫ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক অর্থবছরের দেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চিতি কমেছে ৫ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার। সূত্র জানায়, করোনার সময় দেশে রেকর্ড পরিমাণ প্রবাসী আয় আসে। তখন ডলারের বাজার ও দাম স্থিতিশীল রাখতে ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজার থেকে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার কিনে নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ বেড়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়; যা ছিল ইতিহাসের সর্বোচ্চ। ২০২১-২২ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে সব মিলিয়ে ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত অর্থবছর (২০২২-২৩) বিক্রি করে ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার। এই ধারা অব্যাহত রেখে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১২ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন বা ১ হাজার ২৬৯ কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সব মিলিয়ে গত তিন অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ৩৩ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলার বাজারে ছেড়েছে।
