হাইব্রিড ধান চাষ করে কৃষক সর্বস্বান্ত
ড. এমএ সোবহান
হাইব্রিড ধান প্রবর্তনের সময় থেকেই (১৯৯৮) বিভিন্ন মহল থেকে নানা রকম শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু অধিক খাদ্য উৎপাদনের যুক্তি দেখিয়ে হাইব্রিড ধানের চাষ সম্প্রসারণ করার ব্যথ চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। হাইব্রিড ধান প্রধানত: বোরো মৌসুমেই আবাদ করা হয়। কৃষি মৌসুম হিসাবে বোরো বা রবি মৌসুম বাংলাদেশে সবচেয়ে নিরাপদ মৌসুম অথচ হাইব্রিড ধান প্রবর্তনের সময় থেকেই প্রতি বছর কৃষক পর্যায় হাইব্রিড ধানের ফসল হানির ঘটনা ঘটে চলছে। পত্র পত্রিকায় এ সম্পর্কে এপ্রিল – মে মাসে কিছু লেখালেখি হয়। তারপর আবার যেমন তেমন। বোরো মৌসুমে বীজ তলায় ধানের বীজ বপনের সময় হলে রেডিও, টেলিভিশন ও খবরের কাগজে নানা রকম চটকদার বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। শুধু বিজ্ঞাপন নয় বিশেষ বিশেষ টেভিভেশনে নিজস্ব প্রতিবেদকের আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান মালা প্রচারিত হয়। নানা কৌশলে কৃষককে হাইব্রিড ধান আবাদ করতে উৎসাহিত করা হয়। দেশ বিদেশে হাইব্রিড ধানের সাফল্যের চিত্র দেখানো হয়। কৃষকরা হাইব্রিড ধান চাষ করে অতীতের ক্ষতির কথা ভুলে গিয়ে অথবা অতীতের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য আশায় বুকবেধে আবার হাইব্রিড ধানের আবাদ করেন। ফল যা হবার তাই হয়। কৃষক আবার ক্ষতিগ্রস্ত হন। প্রতি বছরের ন্যায় বর্তমান বোরো মৌসুমেও (২০১১-২০১২) দৈনিক খবরের কাগজে হাইব্রিড ধানের ফসল হানীর খবর প্রকাশিত হচ্ছে। যশোরে হাইব্রিড ধানের বীজে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক (প্রথম আলো, ৮ এপ্রিল ২০১২), যশোর অঞ্চলে হাইব্রিড বোরো ধান চাষ করে চাষীরা বিপাকে (যায়যায় দিন, ৯ এপ্রিল), হাইব্রিড ধানে চিটা শঙ্কি কৃষক (নয়াদিগন্ত, ১৮ এপ্রিল) খোকসার মাঠে দেড়শ বিঘা জমির ধান নষ্ট (ইত্তেফাক, ১৯ এপ্রিল), জামাইবাবু ধান চাষ করে সর্বস্বান্ত অগৈল ঝাড়ার কৃষক। হাইব্রিড ধান চাষ করে সর্বনাশ (আমারদেশ ৮ এপ্রিল)। আমদানী হওয়া হাইব্রিড বীজেই চিটা হচ্ছে (আমার দেশ, ৩০ এপ্রিল)। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকেই বোরো ধানের চিটা হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। শুধু যশোর অঞ্চলেই তিন হাজার হেক্টর জমির হাইব্রিড বোরো ধান চিটা হয়ে গেছে (নয়াদিগন্ত, ১৮ এপ্রিল, ২০১২)। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে গত কয়েক বছরে ধীরে ধীরে হাইব্রিড ধানের আবাদ কমছে। ২০০৮ – ২০০৯ মৌসুমে হাইব্রিড ধানের আবাদ হয় ৮.১৪ লাখ হেক্টরে। ২০০৯-২০১০ মৌসুমে আবাদ হয় ৭.২০ লাখ হেক্টরে। ২০১০-২০১১ মৌসুমে আবাদ হয় ৬.৭২ লাখ হেক্টরে। ২০১১-২০১২ মৌসুমে আবাদ হয় ৬.৬০ লাখ হেক্টরে (নয়া দিগন্ত ১৮ এপ্রিল)। নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষক ও গবেষকদের সাথে হাইব্রিড ধান চাষী আধুনিক কৃষকদের আলাপ আলোচনার মাধ্যমে হাইব্রিড ধান কৃষকদের অনীহার কারণ জানা যায়।
উল্লেখযোগ্য কারণগুলির মধ্যে রয়েছে: ১. চাল নিম্নমানের ২. ছাটাই’র সময় চাল ভেঙ্গে যায় ৩. বীজের দাম বেশী ৪. বাজারে চালের দাম কম ৫. একটু বাতাস হলেই গাছ হেলে পড়ে যায় ৬. রোগবালাই বেশী হয়, (৯) ধান ঝড়ে যায় ৮. চিটা বেশী হয় ৯. প্রত্যাশিত ফলন হয় না ১০. খুব বেশী পরিচর্যা করতে হয় ১১. রান্নার সময় ভাত দলা পাকিয়ে যায় এবং পান্তা ভাত খাওয়া যায় না। সম্পতি বোরো ধানে চিটা ও করণীয় সম্পর্কে ব্রি’র মতামত প্রকাশ করা হয়েছে (ইত্তেফাক, ২১ এপ্রিল ২০১২)। ব্রি’র বিজ্ঞানীবৃন্দ সিরাজগঞ্জ, যশোর, শেরপুর ও ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্ত মাঠ পরিদর্শন করে জানিয়েছেন, “ইনব্রিড উচ্চ ফলনশীল জাতের তুলনায় আমদানীকৃত হাইব্রিড ধানে চিটার পরিমাণ বেশী হয়েছে। মাঠে ফসলের অবস্থাও কৃষকের সাথে আলোচনায় প্রতিয়মান হয়েছে যে, হাইব্রিড জাত চাষ করে কৃষকগণ এ বোরো মৌসুমে আর্থিকবাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন । এ প্রসঙ্গে আরো মতামত দিয়েছেন,হাইব্রিড জাত অনুমোদন দেয়ার পূর্বে রোগ প্রতিরোধ ও পরিবেশ অভিযোজন ক্ষমতা পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট বৈজ্ঞানিকদের সূচিন্তিত মতামতের জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। সেই সঙ্গে ফসলের জাত ও হাইব্রিড ছাড় করার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্তৃপক্ষের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ১৯৯৮ সাল থেকে হাইব্রিড ধানের বীজ আমদানী হচ্ছে। যথেষ্ঠ পরীক্ষা-নিরীক্ষাও হয়েছে। ইতোমধ্যে কৃষকের অনেক ক্ষতি হয়েছে। কৃষক, কৃষি এবং খাদ্য সার্বভৌমত্বের স্বার্থে অবিলম্বে হাইব্রিড ধানের বীজ আমদানী নিষিদ্ধ করতে হবে।