খুলনা কারাগারের ৫ বছরের কাজ শেষ হয়নি ১৩ বছরেও
নিজস্ব প্রতিবেদক : [১] খুলনা জেলা কারাগার নির্মাণ প্রকল্পের গোড়ায় গলদ থাকায় বারবার বেড়েছে ব্যয় ও মেয়াদ। অর্থাৎ প্রকল্পের শুরুতে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়নি। সেই খেসারত দিয়ে হচ্ছে বাস্তবায়ন পর্যায়ে। পাঁচ বছরে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও বাস্তবায়নে লাগছে ১৩ বছর। এখনও শতভাগ বাস্তবায়ন অনিশ্চিত। [২] পাশাপাশি খরচ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। এসব কারণে খরচ করতে হচ্ছে বাড়তি টাকা এবং সময় মতো মিলছে না সুফলও। সেই সঙ্গে বাস্তবায়ন কাজে রয়েছে কিছু ক্রুটিও। [৩] পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নিবিড় পরিবীক্ষণ সমীক্ষার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতায় কারা অধিদফতর এবং গণপূর্ত অধিদফতর। [৪] আইএমইডির সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, আমরা শুধু প্রতিবেদন প্রকাশ করেই দায়িত্ব শেষ করছি না। এসব প্রতিবেদন সুপারিশসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পাঠানো হবে। সেই সঙ্গে তারা কী ব্যবস্থা নিয়েছে সেটিও জানতে চাওয়া হবে। আমরা এসব প্রকল্পের বিষয়ে নিয়মিত মনিটরিং করব। ভবিষ্যতে অন্য প্রকল্পে যেন একই রকম ঘটনা না ঘটে সেজন্য সবাই সচেষ্ট থাকা দরকার। [৫] সূত্র জানায়, খুলনা জেলা কারাগার নির্মাণ প্রকল্পের মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ১৪৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। প্রথম সংশোধনের মাধ্যমে ব্যয় ১০৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা বাড়িয়ে বাড়িয়ে করা হয় ২৫১ কোটি ২ লাখ টাকা। এতেও কাজ শেষ হয়নি। ফলে দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে ব্যয় আরও ৩৭ কোটি ৬ লাখ টাকা বাড়িয়ে করা হয় ২৮৮ কোটি ২৬ লাখ টাকা। [৬] শুধু তাই নয় দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে মেয়াদও। এক্ষেত্রে মূল অনুমোদিত মেয়াদ ছিল ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত, পাঁচ বছর। কিন্তু এতে কাজ শেষ না হওয়ায় ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া প্রথমবার এক বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। এরপর প্রকল্পের প্রথম সংশোধনীতে দুই বছর মেয়াদ বাড়িয়ে করা হয় ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত। এতে কাজ শেস করতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা।
[৭] এবার ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া মেয়াদ আরও একবছর বাড়িয়ে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। এরপর দুবার ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছিল।
[৮] প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধনীতে এতে আরও একবছর বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। এরপর ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ করা হয়। কিন্তু এখনও প্রকল্পের অগ্রগতি এখনও শতভাগ হয়নি। অনেক কাজই বাকি। ফলে ফের মেয়াদ বৃদ্ধির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
[৯] প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, গত মার্চ মাস পর্যন্ত ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৯১ শতাংশ এবং ব্যয় হয়েছে ২২৬ কোটি ৮৮ লাখ টাকা, অর্থাৎ আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৭৯ শতাংশ। কিন্তু এখনও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণাগার, সৌর বিদ্যূৎ, বনায়ন, পানির রিজার্ভার, ফাঁসির মঞ্চ এবং একটি অতিরিক্ত পাম্প হাউজের নির্মাণ কাজের অগ্রগতি শূন্য রয়েছে।
[১০] আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা না হওয়ার কারণে ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) তৈরিতে পূর্ত কাজের প্যাকেজসহ বিভিন্ন অঙ্গ সংস্থানে কিছুটা অসামঞ্জস্যতা ছিল। যে কারণে কাজ শুরু করতেই দেরি হয়েছে। এ ছাড়া আগে থেকেই জমি নির্ধারিত না থাকায় ভূমি নির্বাচন করতে অত্যাধিক সময় লেগেছে।
[১১] প্রকল্পের ডিপিপিতে ভূমি অধিগ্রহণের পর্যাপ্ত বরাদ্দ ধরা না হওয়ায় ভূমি উন্নয়ন ও ভূমি অধিগ্রহণ সম্ভব হয়নি। পরে আন্তঃখাত ব্যয় সমন্বয় করে ভূমির পরিমাণ ঠিক রেখে ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়েছে। পাশাপাশি সঠিক সময়ে প্রকল্পের যাবতীয় নকশা (আর্কিটেকচারাল, স্ট্রাকচারাল, ইলেকট্রিক্যাল, ফায়ার ফাইটিং, রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং এবং ইটিপি স্থাপন প্রভূতি) তৈরি করা হয়নি। আবার বাস্তবায়ন পর্যায়ে ডিজাইন পরিবর্তন ও ডিজাইনের মধ্যে নতুন অঙ্গ সংযোজন করার ফলে অতিরিক্ত সময় চলে গেছে। [১২] এদিকে প্রকল্পের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ৫ জন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ পেয়েছেন। এদের মধ্যে ২ জন অতিরিক্ত দায়িত্ব এবং ৩ জন পূর্ণকালীন দায়িত্বে ছিলেন। বর্তমান প্রকল্প পরিচালকও অতিরিক্ত দায়িত্বে আছেন। ফলে প্রকল্পের অগ্রগতি মন্থর রয়েছে। [১৩] প্রকল্পটি করোনা মহামারি অতিক্রান্ত করায় সেসময় কার্যক্রম ঠিকভাবে করা যায়নি। আবার সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদনের দেরি হওয়ায় ৬টি প্যাকেজের দরপত্র আহ্বানে দেরি হয়েছে। পাশাপাশি রেট সিডিউল পরিবর্তন, দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিসহ নির্মাণ সামগ্রী অপ্রতুলতার কারণেও প্রকল্পটির বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
[১৪] আইএমইডির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সরেজমিন প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনের সময় নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত ইট, বালু, সিমেন্ট, পাথর ও রড ইত্যাদির মান পরীক্ষা করা হয়। এ সময় ঢালাইয়ের সময় ওপিসি এবং প্লাস্টারে পিসিসি ব্যবহার করা হচ্ছে যা সন্তোষজনক।
[১৫] এছাড়া বালু ও পাথরের মান সন্তোষজনক ছিল। কিন্তু ইটের শক্তি ঠিক আছে, তবে আকৃতিগতভাবে ইটগুলো রেগুলারিটি ছিল না। অন্যদিকে যে খোয়া বা চিপ ব্যবহার করা হচ্ছিল সেগুলোর মধ্যে ডাস্ট মিশ্রিত ছিল এবং মান সন্তোষজনক ছিল না। পাশাপাশি নির্মানাধীন অভ্যন্তরীণ ওয়ালের পিলারে স্ট্রিপ বা রিং এর স্পেস ঠিক ছিল না। [১৬] প্রতিবেদনে বলা হয়, সামান্য নির্মাণ ক্রুটি ছাড়া সার্বিকভাবে বাস্তবকাজের মান ভালো। তবে বাকি যেসব ফিটিং ফিনিশিং এর কাজ করা হবে সেগুলোর ম্যাটেরিয়ালের মান যাচাই করে নিতে হবে।
[১৭] প্রকল্পের ড্রেনেজ ব্যবস্থা শহরের কোন মাস্টার ড্রেনেজ ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত না থাকায় যেকোন মুহূর্তে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অতিবৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হতে পারে। প্রকল্পের আওতায় নির্মিত স্থাপনার মালামাল ও সরঞ্জামাদি পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাবে চুরির সম্ভাবনা আছে এবং প্রকল্প এলাকাটি যথেষ্ট নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। [১৮] প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দীর্ঘদিন ফেলে রাখার কারণে লবনাক্ততায় রডের গায়ে মরিচা ধরেছে এবং প্লাস্টার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। উপকূলীয় এলাকায় নির্মাণ কাজের ক্ষেত্রে লবণাক্ততা নিরোধ ব্যবস্থা পরিকল্পনায় থাকা প্রয়োজন ছিল।