কল্লোল মোস্তফা
কোটা ব্যাবস্থা প্রযোজ্য হতে পারে কেবল বৈষম্যের শিকার হওয়া পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী কিংবা শ্রেণীর জন্য।
দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতি-নাতনীরা আলাদা ভাবে বৈষম্যের শিকার বা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী নন; দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যে মাত্রায় পিছিয়ে পড়া, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনীরা সে মাত্রায় পিছিয়ে পড়া।
কেবল মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনী হওয়ার জন্য কারও শিক্ষা কিংবা চাকুরির সমস্যা হয় এরকমটা কখনও ঘটে না, যেমনটা হয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কিংবা প্রতিবন্ধীদের।
মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনীদের শিক্ষা কিংবা চাকুরির যে সমস্যা, তার কারণ দারিদ্র ও বৈষম্য, পিতা-মাতার মুক্তিযোদ্ধা হওয়া নয়। ফলে কোটা দিতে হলে তো দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা থাকা দরকার।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কিংবা প্রতিবন্ধীরা নানান কাঠামোগত কারণে দরিদ্রদের মধ্যে আরো দরিদ্র, আরো বঞ্চিত। ফলে তাদের জন্য বিশেষ কোটা রাখা যুক্তিযুক্ত।
মুক্তিযুদ্ধের পর পর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা রাখা কিংবা চাকুরির বয়স সীমা বাড়িয়ে ৩২ বছর করা ইত্যাদি যুক্তিযুক্ত হলেও বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের সন্তান ও নাতি-নাতনীদের জন্য সরকারি চাকুরিতে ৩০ শতাংশ কোটা রাখার কোন যুক্তি নেই।
নারীরা পড়াশোনায় ভাল করছেন, জেলাগুলোর মধ্যেও খুব বেশি পার্থক্য নেই। বৈষম্য যা আছে তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মূলত দারিদ্রের জন্য। যথাযথ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর মাধ্যমে তার নিরসন করা দরকার। জেলা বা নারী কোটা থাকলে তার সুবিধা অনেক সামর্থ্যবানরাও ভোগ করেন, যা আরেক ধরণের বৈষম্য তৈরী করে। ফলে জেলা বা নারী কোটা কতটা যৌক্তিক সে বিষয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
প্রতিবন্ধীসহ সমাজের অনগ্রসর অংশের জন্য সব মিলিয়ে ১০ শতাংশ কোটা রেখে বাকি চাকুরি মুক্ত প্রতিযোগীতার মাধ্যমেই নির্ধারিত হওয়া দরকার।
মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ব্যাবস্থার জন্য, যে রাষ্ট্র ব্যাবস্থায় সকল নাগরিকের খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থানের দ্বায়িত্ব নেবে রাষ্ট্র।
স্বাধীনতার পর থেকে শাসকেরা দেশী বিদেশী লুটেরাদের মুনাফার ব্যবস্থা করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের এই আকাঙ্খার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে চলেছে।
মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনীদের জন্য সরকারি চাকুরিতে কোটা রাখা হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে এই ধারাবাহিক বিশ্বাসঘাতকতাকে আড়াল রাখার তরিকা, এক ধরণের ঘুষ।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনুযায়ী একটি বৈষম্যহীন স্বাধীন কল্যাণমূলক অর্থনৈতিক ব্যাবস্থা গড়ে তুললে শিক্ষা-বস্ত্র-বাসস্থান-কর্মসংস্থানের মতো মৌলিক অধিকারগুলো শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদেরই নয়, দেশের সকল নাগরিকেরই প্রাপ্য হতো, এর জন্য কোটা ব্যাবস্থার মতো একটি বৈষম্যমূলক ব্যাবস্থার কোন প্রয়োজন হতো না।
মুক্তিযোদ্ধাদের যদি সন্মান দিতে হলে, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনীদের কোটা-ঘুষ দিয়ে নয়, মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্খার শোষণ-বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়েই দিতে হবে।