
বিসিএসের ক্রেজের পিছনের মূল কারণ কয়েকটা

আজাহার উদ্দিন অনিক
দেখেন, বিসিএস অথবা বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান (রাজউক, সিটি কর্পোরেশন) ইত্যাদিতে যারা চাকরি পাইতে চায়, তাদের কারো কারো ইচ্ছা হয়ত আসলেই মতিউর বা বেনজিরের মত দুর্নীতিবাজ হওয়া, কারণ শূন্য থেকে কোটিপতি হওয়ার এর চেয়ে ভাল কোন রাস্তা এই মুহুর্তে নাই বাংলাদেশে। তাই যাদের এই ইচ্ছা আছে এবং যাদের পলিটিকাল কোন পাওয়ার বা কোটা নাই, তাদের জন্য এত কোটা ব্যবস্থা একটা গলার কাঁটাই বটে। সিস্টেমে ঢুকে সিস্টেম পাল্টানোর গল্প কয়েক যুগ ধরেই একটা মিথ ছাড়া আর কিছুই না। যারা সিস্টেমে ঢুকবে তারা হয় সিস্টেমের অংশ হবে নাহয় সিস্টেম তাদেরকে বের করে দিবে। এজ সিম্পল এজ দ্যাট।
এই ডিসক্লেইমারটুকু যেহেতু শুরুতেই বলে নিয়েছি, এইবার আসল কথায় আসি।
বিসিএস যারা দিতে চায় সবাইই কি দুর্নীতি করে টাকা কামাই করার জন্য ঢুকতে চায়? আমার মনে হয় না। বিসিএসের ক্রেজের পিছনের মূল কারণ কয়েকটা।
১- চাকরির বাজারে চাকরির স্বল্পতা।
২- সরকারি চাকরির নিরাপত্তা। (অর্থাৎ আপনি একবার সরকারি চাকরিতে ঢুকলে আপনার চাকরি চলে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। বড়জোর আপনার বদলি হইতে পারে, চাকরি যাবে না।)
৩- কর্পোরেট সেক্টরে (হাতেগোণা কয়েকটা ফিল্ড বাদে) ভয়াবহ এক্সপ্লয়টেশন। অর্থাৎ যেই চাকরি/কাজের জন্য আপনার বেতন পাওয়ার কথা ১ লাখ টাকা সেই কাজটার জন্য আপনি বেতন পাচ্ছেন ৩০-৪০ হাজার টাকা, কারণ দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং চাকরির বাজার এতই খারাপ যে আপনি এই চাকরি না করলেও অন্য কেউ ঠিকই করবে। কর্পোরেট ফিল্ডে আপনার স্কিলের ডিমান্ড যদি এক্সসেপশনাল না হয়, চাকরি চলে যাওয়ার সম্ভাবনাও অনেক বেশি থাকে।
৪- বিভিন্ন সিন্ডিকেট এবং মনোপলির কারণে সৎভাবে ব্যবসা করে বা কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করা প্রায় অসম্ভব। আপনি যেই ফসল উৎপাদন করে ২ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হবেন, রাজনৈতিক সিন্ডিকেটগুলোর কারণে সেই ফসল ঢাকায় বিক্রি হবে ২০০ টাকা দামে। আপনি চাইবেন আপনার সৎ ব্যবসার জন্য কাঁচামাল আমদানি করতে, কিন্তু ডলার সংকটের কারণে আপনি এলসি পাবেন না, পাবে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋনখেলাপী এবং টাকা পাচার করা বড় কোম্পানিগুলো।
৫- ক্ষমতা। আপনি রাস্তায় হাটেন অথবা স্বাভাবিক কোন নাগরিক সুবিধা নিতে চান, দেশের প্রত্যেকটা স্তরে এত বেশি দুর্নীতি আছে এবং প্রত্যেকটা সেক্টর এত বেশি মিসম্যানেজড, স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করতে হইলেও আপনার মিনিমাম লেভেলের ক্ষমতা দরকার। যারা শূন্য থেকে উঠে আসে তাদের যেহেতু রাজনৈতিক বা পরিবারের সূত্রে কোন ক্ষমতা থাকে না, তাদের জন্য এই মিনিমাম ক্ষমতা দেখানোর একমাত্র উপায় সরকারি চাকরি। আপনি সাধারণ নাগরিক হিসেবে যেই সুবিধাটা আপনার প্রাপ্য কিন্তু পাচ্ছেন না, আপনি পুলিশ/ম্যাজিস্ট্রেট হইলে ঠিকই সেই সুবিধা আপনি পেয়ে যাবেন। আপনার সাথে একটা অন্যায় হইলে সাধারণ নাগরিক হিসেবে হয়ত আপনি কোন সুরাহা পাবেন না, সরকারি চাকরিধারী হইলে আপনি পাবেন।
৬- ২০ বছর ধরে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্নীতি/গাফিলতি, বিচার বিভাগের এবং দুদকের মত সংগঠনগুলোর ব্যর্থতার কারণে কখনই দেশে দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারীদের আইনের মুখোমুখি করা হয় নাই। তাই সরকারি কোন চাকরিতে ঢুকলেই বিপুল টাকা-পয়সা উপার্জন করা এখন পুরো দেশেই নর্মালাইজড এবং এই কারণে নতুন জেনারেশনগুলোর মধ্যে সরকারি চাকরির প্রতি ফ্যাসিনেশনও বেশি। আগে তাও অবৈধভাবে ঘুষ নিতে হইত, এখন পুরো সিস্টেম এতটাই করাপ্ট যে অবৈধ উপার্জনের বিভিন্ন লিগ্যাল রাস্তাই খুলে দেয়া হয়েছে। চাইলেই বিদেশে ভ্রমণ, অফিশিয়াল গাড়ি হিসেবে মার্সিডিজ/রেঞ্জ রোভার কেনা – এইসব কাজকর্ম এখন অফিশিয়াল নোটিশের মাধ্যমেই করা হয়।
৭- সরকারি চাকরির নিয়োগে বৈষম্য না থাকা। অর্থাৎ, আপনার পরিবারে যদি বিএনপি জামাত না থাকে, আপনি যদি কখনো সরকারের দুর্নীতির সমালোচনা না করে থাকেন, কোটা সিস্টেম বাদ দিয়ে ধরলে সরকারি চাকরির নিয়োগ ব্যবস্থা অনেকক্ষেত্রেই বেশ ফেয়ার। আপনার লবিইং না থাকলেও আপনি চাকরি পাইতে পারবেন। সরাসরি পরীক্ষা না দিয়ে কোন ছাত্রলীগ নেতা আপনাকে টপকায়ে চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
৮- সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির কারণে যেই অবস্থা দাড়িয়েছে, বেশিরভাগ সাবজেক্টে আপনি যদি ৫ বছর পড়াশুনা করে ফার্স্টও থাকেন, এরপরেও পলিটিকাল লবিং এর কারণে আপনার জায়গায় যার পজিশন প্রথম ১০/২০ এর পরে তাকে শিক্ষক হিসেবে নিয়ে নেয়া হইতে পারে। এত তুলনায় আপনি যদি ৫ বছর বিসিএস নিয়ে পড়াশুনা করেন এবং আপনার মিনিমাম কম্পিটেন্স থাকে, বিসিএস বা যেকোন সরকারি চাকরি পেয়ে যাওয়া আপনার জন্য নিশ্চিত।
এছাড়াও, অনেকগুলো সাবজেক্টেই অনেক বছর ধরে ছাত্র নেয়া হয় অনেক বেশি, সেই তুলনায় কোন চাকরির বাজার না থাকলেও। এইসব সাবজেক্টের ছাত্রদের জন্য নিজের সাবজেক্টে চাকরি খোঁজার চাইতে সরকারি চাকরিতে ঢুকার চেষ্টা করাই বেশি নিরাপদ।
যদি দেশের চাকরির বাজার এবং বেকারত্বের অবস্থা এমন না হইত, মিনিমাম রেগুলেশন থাকত ফেয়ার পে নিয়ে, সাধারণ নাগরিক হয়েও আপনার প্রাপ্য সুবিধাগুলো আপনি রাষ্ট্রের কাছ থেকে পাইতেন এবং দেশে প্রত্যেকটা খাতে এত ভয়ংকর দুর্নীতি না থাকত, সরকারি চাকরি বা বিসিএস নিয়ে এত ক্রেজ হয়ত থাকত না। হাতে বেটার অপশন থাকলে এই ২০-৩০ হাজার টাকার স্টার্টিং স্যালারিতে কারো ঢুকতে চাওয়ার কথা না।
একটা বিষয় নিশ্চিত, সরকারি চাকরিতে যেই ঢুকুক না কেন, তারা সাধারণত সিস্টেম পাল্টানোর খায়েশ নিয়ে ঢুকছে না বা দুর্নীতি মোকাবেলার খায়েশ নিয়েও ঢুকছে না। তাইলে সরকারের কী যায় আসে এইখানে কোটা দিয়ে কোন “স্পেশাল” পরিবারের সন্তান ঢুকানো হচ্ছে নাকি সাধারণ কোন কৃষকের “সন্তানকে”?
একটা এনালজি দিয়ে বুঝাই। আপনি বিসিএস দিয়ে পুলিশ সার্ভিসে হয়ত ঢুকতে পারবেন সাধারণ ছাত্র হয়েই। কিন্তু ঢাকার আশেপাশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ থানায় এবং পজিশনে কখনো ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ততা বাদে অন্য কাউকে দায়িত্ব পাইতে দেখবেন না।
মাথা খাটায়ে বুঝে নেন আমি কী বুঝাচ্ছি। সরকারের শুধু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা দরকার এমন না, সরকারের দরকার তাদের প্রতি লয়্যাল দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা। এই লয়্যালটি আপনি তখনই নিশ্চিত করতে পারবেন যদি আপনি আপনার প্রতি লয়্যাল কিন্তু অযোগ্য/কম মেধাবী এমন কাউকে চাকরি পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।
যারা সরকারি চাকরি পাইতে চাচ্ছে না, তাদের কি তাহলে এই কোটা ব্যবস্থা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোন দরকার আছে? একটা তিতা সত্য কথা হচ্ছে এই মুহুর্তে নিজেদের সরকারি চাকরির আবেদনে বৈষম্যের প্রতিবাদে যারা রাস্তায় আছে তাদের অনেককেই আপনি আপনার নিজের বিরুদ্ধে হওয়া কোন অপরাধ/বৈষম্যের সময় পাশে পাবেন না।
আপনার কী ঠেকা পড়েছে সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে মাথা ঘামানোর?
দেশের যেই অবস্থা, আপনি এমনিতেও সরকারি কোন সার্ভিস থেকে আপনার প্রাপ্য সুবিধা পাচ্ছেন না। সিটি কর্পোরেশনের কারণে আপনার বাসার সামনের রাস্তা নষ্ট, ওয়াসার কারণে বাসায় পাচ্ছেন নোংরা পানি, কোন সরকারি অফিসে মিনিমাম কোন কাজ করাইতে গেলে আপনার ঘুষ দিতে হচ্ছে, ইনফ্লেশনের কারণে প্রত্যেকটা জিনিসের দাম বেড়ে গেলেও এই পরিস্থিতির লাগাম টেনে ধরার দায়িত্ব যেই সরকারি কর্মকর্তাদের তাদের কোন খবর নাই, কাস্টমসের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের জন্য বিদেশ থেকে ফেরত আসার সময় আপনি হেনস্থার স্বীকার হচ্ছেন, যেই পুলিশের অপরাধ দমন করার কথা সেই পুলিশের মধ্যেই অপরাধপ্রবণতা সবচাইতে বেশি।
পুরো পোস্ট ধরেই আমি সরকারি চাকরির সমালোচনাই করে গেলাম অনেক অংশে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, কোটা সিস্টেম নিয়ে কি তাইলে আদৌ যারা বিসিএস দিবে না তাদের মাথা ঘামানোর দরকার আছে? অবস্থাটা কি আসলে এমন যে দেশের সার্বিক অবস্থার উন্নতি হওয়ার আগে কারা এই গুটিকয়েক সরকারি চাকরি পাচ্ছে বা পাচ্ছে না এইটা নিয়ে মাথা ঘামায়ে কোন লাভ নাই বাকিদের?
না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষার্থী সরকারি চাকরি পাওয়ার পরে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা হবে কি হবে না সেইটা নিয়ে ডাউট থাকতে পারে। আমার পরিচিত অনেকেই যারা সরকারি চাকরিতে ঢুকেছেন যারা সৎ থাকবেন বলেই আমি মনে করি। আমার পরিচিত কিছু বন্ধুবান্ধবের সরকারি চাকুরি থাকা বাবা-মায়ের ব্যাপারেও আমি জানি যে তারা সব সময়ে সৎ ছিলেন, কিছুক্ষেত্রে এই সততার জন্য তাদেরকে শাস্তিভোগ করতে হইলেও। সরকারি সার্ভিসে এখনো কিছু সৎ কর্মকর্তা আছেন।
তাই এই মুহুর্তে যারা রাস্তায় আছে, যারা অনেকে এর আগে বিভিন্ন আন্দোলনেও রাস্তায় ছিল, এদের কেউ যদি সরকারি চাকরিতে ঢুকে, ২০ বছর পরে এদের কাছে দেশের সম্পদ হয়ত নিরাপদে থাকতেও পারে, এদের কাছ থেকে আপনি নাগরিক হিসেবে প্রাপ্য সার্ভিস আপনি পাইতেও পারেন। যারা সরকারি চাকরির নিয়োগে কোটা পদ্ধতির সংস্কার/বিলুপ্তি চায়, তাদের সবাই হয়ত দুর্নীতি করার জন্যেই সরকারি চাকরিতে ঢুকতে চাচ্ছে না। অনেকেই হয়ত চাকরির নিরাপত্তা, সোশাল স্ট্যাটাস বা এমনকি দেশের মানুষকে সার্ভ করার জন্যেই সরকারি সার্ভিসে ঢুকতে চাচ্ছে।
কিন্তু সারা জীবন কোটা সিস্টেম এক্সপ্লয়েট করে যাওয়া এবং অযোগ্য লোকেরা যদি সরকারি চাকরিতে ঢুকার সময় প্রায়োরিটি পায়,
তাদের হাতে দেশ এবং আপনার ভবিষ্যত নিরাপদে থাকার কোন সম্ভাবনাই নাই।
