গাজায় কেন ভারতের অস্ত্র
প্রণয় শর্মা
গাজায় যুদ্ধের জন্য ভারত ইজরায়েলকে যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ চালিয়ে যাবে কি না, সে প্রশ্নটা ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে। পশ্চিমের কিছু দেশকে বাদ দিলে, গাজার উপর ইজরায়েলের আক্রমণ বিশ্বের কোথাও সমর্থন পায়নি। প্যালেস্টাইনের নিরীহ, অসহায় নাগরিক, বিশেষত মহিলা ও শিশুদের বোমাবর্ষণে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা হিসেবেই দেখা হচ্ছে ইজরায়েলের আক্রমণকে।
ভারত যে ইজরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ করছে, সে কথা সম্প্রতি একটি সংবাদমাধ্যমের কাছে স্বীকার করেছেন ভারতে ইজরায়েলের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত ড্যানিয়েল কামরন। সরকার সে কথাকে খারিজ করেনি, আবার সমর্থনও করেনি। সম্ভবত তার কারণ, সারা বিশ্ব যখন ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন যুদ্ধের নিন্দা করেছে, তখন তার সঙ্গে জড়িত থাকা সরকারের কাছে অস্বস্তিকর।
আসলে ভারত পড়েছে দোটানায়। ১৯৬২, ১৯৬৫, ১৯৭১, ১৯৯৯: প্রতিটিতেই ভারতকে অস্ত্র সরবরাহ করেছে ইজ?রায়েল। ইজরায়েলের প্রয়োজনের সময়ে ভারত কি তার প্রতিদান দেবে না? কূটনৈতিক ক্ষেত্রে ইজরায়েল ভারতের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে একটা সহমত তৈরি হয়েছে যে, তেল আভিভের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করতে হবে। ভারত-ইজরায়েলের সম্পর্ক শক্তিশালী হলে তাতে আমেরিকার প্রভাবশালী ইহুদি লবি ভারতের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব নেবে, এবং আমেরিকা-ভারত সম্পর্ক আরও বলিষ্ঠ হবে, সে প্রত্যাশাও রয়েছে।
তা ছাড়া, ভারত যে সব ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করছে ইজরায়েলকে, তা হায়দরাবাদে তৈরি হচ্ছে দু’টি সংস্থার উদ্যোগে, ইজরায়েলের এলবিট সিস্টেমস এবং ভারতের আদানি গ্রুপ। অস্ত্র তৈরির প্রযুক্তি ইজরায়েলেরই দেওয়া, এবং উৎপাদন ব্যবস্থার অর্ধেক মালিকানাও ইজরায়েলি সংস্থার। তা হলে ভারত কী করে অস্ত্র জোগাতে অসম্মত হতে পারে?
তবে ইজরায়েলকে সামরিক মদত জোগানোর কঠোর সমালোচনা শুরু হয়েছে ভারতেই। সমালোচকরা বলছেন, ভারতকে ইজরায়েল যুদ্ধাস্ত্র পাঠিয়েছিল বাণিজ্যিক চুক্তির জন্য— ভারতকে সমরাস্ত্র বিক্রির আন্তর্জাতিক টেন্ডার জিতেছিল ইজরায়েল। অস্ত্র বিক্রি করে তারা প্রচুর অর্থ নিয়েছে, বিনা পয়সায় অস্ত্র দেয়নি। আরও জরুরি কথা, সে সব অস্ত্র ভারত ব্যবহার করেছে অন্যান্য দেশের সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে, অস্ত্রহীন, নিরপরাধ নাগরিকদের উপর হামলা করার জন্য নয়। কিন্তু ইজরায়েল উন্নত প্রযুক্তির সমরাস্ত্র দিয়ে নিরীহ প্যালেস্টাইনিদের হত্যা করছে। এটা একটা অন্যায় যুদ্ধ যাকে ভারত কখনওই সমর্থন করতে পারে না।
কাকে ন্যায় যুদ্ধ বলা চলে, এ বিতর্ক বহু দিনের। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পরে প্রশ্নটি মাথাচাড়া দিয়েছিল। আমেরিকায় নীতিবিদ্যার বিখ্যাত দার্শনিক মাইকেল ওয়ালজার ১৯৭৭ সালে একটি গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করেন, যার নাম জাস্ট অ্যান্ড আনজাস্ট ওয়র্স— যুক্তি দেন যে, যুদ্ধে বড় সংখ্যায় অসামরিক জনগণের হত্যা হলে তা নৈতিক সমর্থনের যোগ্য নয়। অতএব ভিয়েতনামের যুদ্ধ অন্যায্য।
প্যালেস্টাইনের উপরে ইজরায়েলের সাম্প্রতিক আক্রমণকে গোড়ার দিকে কেউ কেউ সমর্থন করেছিলেন। কারণ ইজরায়েলের উপর প্রথম আক্রমণ করেছিল প্যালেস্টাইনের সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী হামাস। ৭ অক্টোবর ২০২৩, হামাসের সেই আক্রমণে ইজরায়েলের এগারোশোরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। আড়াইশো ইজরায়েলিকে পণবন্দি করে হামাস। এর প্রতিক্রিয়ায় ইজরায়েল যখন গাজা আক্রমণ করেছিল, তখন অনেকে তাকে উচিত জবাব বলে মনে করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের পক্ষেও ইজরায়েলের পাশে থাকা কঠিন হচ্ছে। কারণ, এখনও অবধি ইজরায়েলের হানায় প্রাণ হারিয়েছেন প্যালেস্টাইনের সাঁইত্রিশ হাজার মানুষ, যাঁদের অধিকাংশই মহিলা ও শিশু। ভিয়েতনামে এক জন সেনা পিছু দু’জন নাগরিক প্রাণ হারিয়েছিলেন, গাজাতে এখনও অবধি এক জন সেনা পিছু অন্তত সাত জন নাগরিক।
ইজরায়েলের সামরিক বাহিনী দহিয়া নীতি গ্রহণ করেছে। যা বলে, প্রতিপক্ষের উপর চাপ সৃষ্টি করতে নগর-পরিকাঠামো ধ্বংস করা অযৌক্তিক নয়। পাটকেল খেলে থানইট ফিরিয়ে দেওয়া দরকার। সেই অনুসারেই ইজরায়েল প্রথম ছ’দিনে ছ’হাজার বোমা বর্ষণ করে গাজায়। পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করে আমেরিকার রাষ্ট্রনীতির শিক্ষক ডেভিড সি হেন্ডরিকসন বলেছেন, নিরপরাধ নাগরিককে যথাসম্ভব বাঁচিয়ে হামাসকে কী করে শেষ করা যায়, তা ইজরায়েল জানে না। এই যখন ইজরায়েলের অবস্থান, তখন ভারত কোন যুক্তিতে তাকে অস্ত্র পাঠাতে পারে? বিশেষত ভারত যেখানে বরাবরই প্যালেস্টাইনকে সমর্থন করেছে? গান্ধী, নেহরু থেকে বাজপেয়ী সকলেই প্যালেস্টাইনিদের নিজস্ব ভূখণ্ড পাওয়ার অধিকারের সপক্ষে কথা বলেছেন। বরং পাকিস্তান বরাবর একে একটি মুসলিম প্রশ্ন বলে দেখাতে চেয়েছে। হিন্দু-ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের উপর পাকিস্তানের দাবির প্রতি সমর্থন জোটাতে চেয়েছে।
বিশ্বের কাছে ভারতের ভাবমূর্তি এক শান্তিকামী দেশের। নিজেকে উন্নয়নশীল বিশ্বের নেতা বলেও দেখতে চায় ভারত। তার সঙ্গে ইজরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ কতটা সাযুজ্যপূর্ণ, সেই প্রশ্ন উঠতে বাধ্য।