কবিতা সকলের জন্য নয়, মধ্যবিত্তের মাস্টারবেশন!
আহসান হাবিব
কবিতা সবার জন্য নয় কথাটায় একটা ফাঁকি আছে কিংবা একটা দাম্ভিকতা। কবিতাকে কেউ কেউ সকল আর্টের সেরা বলতে চায় এটাও সেই দাম্ভিকতার প্রকাশ বলেই মনে হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে কোনো শিল্পই সকলের জন্য নয়। এক একটা শিল্প এক একটা শ্রেণির জন্য। অবশ্য সকল শ্রেণিরই নিজস্ব আর্ট বা শিল্প আছে। তাদের প্রত্যকের ভোক্তা আলাদা আলাদা। এই যে আলাদা, সেটা একটা দ্বন্দ্বকে প্রকাশ করে। আর তা হচ্ছে শ্রেণিদ্বন্দ্ব। কবিতারও রকমফের আছে। যখন একজন লোককবি কবিতা রচনা করেন, তখন নাগরিক কবিরা তার প্রতি তাচ্ছিল্য দেখান। এই তাচ্ছিল্যই শ্রেণিদ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ।
কে বলেছিল প্রথম এই কথাটা যে কবিতা সবার জন্য নয়? বুদ্ধদেব বসু কিংবা জীবনানন্দ যেই বলুক, কোনো লোক কবি এই কথা বলেননি, এটা হলফ করে বলা যায়। কেন বলেননি? কারণ তিনি মনে করেন না যে কবিতা সকলের জন্য নয়। লালন যখন বলেন, মিলন হবে কতদিনে আমার মনের মানুষের সনে কিংবা সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে তখন শুধু লালনের শ্রেণি নয়, সব শ্রেণির মানুষ এটা হৃদয়ঙ্গম করতে সমর্থ হয়। তাহলে বলা যায় কবিতা সকলের জন্য নয়, কথাটা আদতে ঠিক নয়। এই যে লালনের দুটি গানের কথা বললাম, একে আমি সুর ছাড়া শ্রেষ্ঠ কবিতা নামেও অভিহিত করি। তাহলে কোন কবিতা সকলের জন্য হয়ে ওঠে না?
তখন আমার নাগরিক আধুনিক কবিতার কথা মনে পড়ে যায়। জীবনানন্দের যেকোনো একটি কবিতা একজন কৃষক কিংবা শ্রমিককে শোনান, তারা কেউ এর রস উপভোগ করতে সমর্থ হবে বলে মনে হয় না। কেন? কারণ এর ভাষা, এর গঠন, বলবার ভঙ্গি তাদের অচেনা। কিন্তু তারা যখন জসীমউদ্দীনের সোজন বাদিয়ার ঘাটর যেকোনো একটা কবিতা শুনবে, চট করে বুঝে ফেলবে এবং তার সমূহ রস উপভোগ করতে পারবে। এটা কি নাগরিক কোনো মানুষ উপভোগ করবে না? করবে। তারা এই কবিতার সঙ্গে যুক্ত হবে অন্যরকম এক আবেগ দিয়ে, এখানে হয়তো তাদের নস্টালজিয়া কাজ করবে। কিন্তু তারা এর রূপ রস উপভোগ করতে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হবে না। তবে তারা যেহেতু ওই জীবন ছেড়ে এসেছে, তাই এর কাব্য সৌন্দর্যে তেমন মুগ্ধ নাও হতে পারে। তার শ্রেণিগত অবস্থান বদলে গেছে। সে অলরেডি নাগরিক মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্গত হয়ে পড়েছে এবং রুচি বদলে গেছে। এই শ্রেণিটাই যে শিল্পচর্চা করে, তা আর তার ফেলে আসা জীবনকে শিল্পায়িত করতে পারে না। নাগরিক জটিলতা, আধুনিকতার নামে বিবিধ কাঠামোর আবিষ্কার এবং শিল্পে এর প্রয়োগ করে তাদের আধুনিক জটিল মননকে শান্ত করে। এই আবিষ্কার বা কাঠামোর পরিবর্তনের সংগে সমাজ কাঠামোর পরিবর্তনের সম্পর্ক আছে। একটা সমাজ ব্যবস্থা যখন নতুন আর একটি ব্যবস্থায় উন্নীত হয়, তখন কাঠামো বদলে যায় এবং ফলে তার আধেয়গুলির রূপও বদলে যায়। একই ব্যবস্থার ভেতরে কাঠামো বা আধার বিবর্তিত হয় এবং তখন তার প্রকাশও বদলে বদলে যায়। শিল্প আন্দোলন নামের বিবিধ আন্দোলনগুলি তারই সাক্ষর।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পৃথিবীর সবকিছুই পণ্য। শিল্পও পণ্য। কবিতা গান চিত্রকলা- সবই পণ্য। মানুষ নিজেই পণ্য। ফলে এই ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী শিল্প একটি সামাজিক পণ্য, আর সব-(চাল ডাল শার্ট ব্রা) পণ্যের মতোই, কিন্তু এর ভোগ সামাজিক নয়, ব্যক্তিক। ফলে সব পণ্য সবাই কিনতে পারে না, জীবনধারণের জন্য যতটুকু না হলে নয়, ততটুকই তারা কেনে এবং ভোগ করে। শিল্পও সবাই কিনতে পারে না, কেনে সমাজের সেই শ্রেণি যারা উচ্চবিত্ত অর্থাৎ ধনিক শ্রেণি। এর সংগে যুক্ত হয় শিল্পের মর্ম বুঝে একে উপভোগ করার বিষয়টি। নাগরিক শিল্প চর্চা এবং বোধের বিষয়টি যেহেতু মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ, তারা এর স্রষ্টা এবং বিক্রেতা কিন্তু ভোক্তা নয়। এটা বিক্রি করে শুধু তারা এর বিনিময় মূল্যটাই পায়। যে শ্রেণি তাদের পণ্য মানে এই শিল্প কিনে নেয়, তারা এর শৈল্পিক মূল্য বুঝুক না বুঝুক, তাতে কিছু যায় আসে না। তাহলে যে শিল্প সকলের জন্য নয় বলে ঘোষণা করা হয়, তার ক্রেতা কে? ধনিক শ্রেণি। শিল্পকে ভালোবেসে মধ্যবিত্ত শ্রেণিও কেনে কিন্তু কেনে তাদের সামর্থ্যের মধ্যে। হয়তো তারা একটা কবিতা বা গল্প বা উপন্যাসের বই কিনলো, কিন্তু একটি পেইন্টিংস কেনা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তখন এইসব শিল্প চর্চাকারী মধ্যবিত্তরা একটা নীচ মানসিক জটিলতায় আক্রান্ত হয়। এখান থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই তারা রটিয়ে দেয় যে শিল্প সকলের জন্য নয়। এটা মধ্যবিত্ত মানসিক জটিলতার নিষ্ক্রমণ। যৌন ভাষায় একে মাস্টারবেশন বলে। কিন্তু আসলে কি শিল্প সকলের জন্য নয়, কথাটা কি ঠিক?
কথাটা ঠিক নয়, শিল্প সকলের জন্য। যে শিল্প সকলের হতে পারে না, তা খণ্ডিত। তবে সব শিল্পের চরিত্র এক নয়। যেমন সংগীত। সংগীতের বৈশিষ্ট্যের কারণেই এটা সব শ্রেণির হয়ে ওঠার ক্ষমতা রাখে। তবে সব সংগীত সব শ্রেণির মানুষ উপভোগ করতে পারে না। যেমন রশিদ খানের ক্ল্যাসিকাল অনুষ্ঠান উপভোগ করে ঢাকা ক্লাবের ধনিক শ্রেণি। কিন্তু এটা যদি খোলা প্রান্তরে গীত হয় এবং সব শ্রেণির মানুষের প্রবেশাধিকার থাকে, তাহলে সবাই নিজের নিজের মতো করে উপভোগে সক্ষম। শ্রেণিবৈষম্যই শিল্পকে কুক্ষিগত করে রাখে বিশেষ শ্রেণির দখলে। মধ্যবিত্ত যেহেতু বুর্জোয়া শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হতে না পারার জটিলতায় ভোগে, তাই এই হতাশা থেকে মুক্তি পেতে তার সৃষ্ট শিল্পকে সকলের জন্য নয় বলে জাহির করে। তাই শিল্প বিশেষ করে কবিতা সকলের জন্য নয় কথাটা আসলে মধ্যবিত্তের মাস্টারবেশন। লেখক: কথাসাহিত্যিক