ইঁদুর নিছক একটি গল্প নয়, একটি সমাজও
মুজিব রহমান : আমরা এখনও ইঁদুরের মতোই বাস করি। প্রায় শত বছর আগে সোমেন চন্দের সেই অনুভব আজো অনুভূত হয় আমাদের মস্তিষ্কে। এই নষ্ট সময়েও, বাকস্বাধীনতাহীন বর্তমানেও সোমেন চন্দদের বেঁচে থাকা কঠিনতরই। সোমেন চন্দ বেঁচেছেন ২২ বছরেরও কম। দেশে রাজনীতির শিকার হয়ে যে সকল মেধাবী তরুণ অকালে প্রাণ হারিয়েছেন তাদের অন্যতম হলেন সোমেন চন্দ। তাকে বলা হয় দেশে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম শহীদ। আবার বাংলা সাহিত্যে তিনিই প্রথম গণসাহিত্যের উপর কাজ করেন। আজ তিনি মূল্যায়িত হচ্ছেন রাজনৈতিক কারণে নয়, ওই সামান্য সময়ে অবদান রাখা সাহিত্যের জন্যই। সে কারণেই কলকাতা বাংলা একাডেমি প্রবর্তন করেছে সোমেন চন্দ পুরস্কার। তাঁর রচনার পরিমাণও সামান্যই। মাত্র ১৭ বছর বয়সে লেখা একটি উপন্যাস আর কয়েকটি গল্প। সেই গল্পের মধ্যে ইঁদুর এমন একটি গল্প যাতে নিপুণভাবেই উঠে এসেছে মধ্যবিত্তের হাহাকার। সেই হাহাকার অনুরণিত হয় আমাদের শিরায় শিরায়। বহু ভাষায় অনুদিত হওয়া গল্পটি বিশ্বের দরবারে বাংলা সাহিত্যকে পরিচিত করাতে ভূমিকা রেখেছে। পঠিত হচ্ছে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ একটি গল্প হিসেবে। ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ তার ‘নন্দিত নরকে’ ও ‘শঙ্খনীল কারাগার’ লেখার প্রেরণা হিসেবে বলেছেন ‘ইঁদুর’ গল্পটির কথাই।
আমাদের বাসায় ইঁদুর এত বেড়ে গেছে যে আর কিছুতেই টেকা যাচ্ছে না। এটাই গল্পের প্রথম বাক্য। গল্পটি প্রতীকী চেতনার হলেও একটি মধ্যবিত্ত পরিবার, যেখানে ইঁদুর মারা কল কেনার টাকারও সংকট থাকে সেখানে ইঁদুরের উৎপাত বাড়তেই থাকে। নাম দেখেই মনে হবে-মাধ্যবিত্ত মানুষকেই তুলনা করেছেন ইঁদুরের সাথে। অর্থাৎ মধ্যবিত্তের টানাপোড়েন, অভাব অনটন আর দরিদ্র জীবনের সুক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গিই থাকবে গল্পে। গল্পের প্রথম অনুচ্ছেদের পরের বাক্যগুলোও পড়ে দেখবো রয়েছে নিছক ইঁদুরের কথাই-চোখের সামনেই, যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যদলের সুচতুর পদক্ষেপে অগ্রসর হওয়ার মতো ওরা ঘুরে বেড়ায়, দেয়াল আর মেঝের কোণ বেয়ে-বেয়ে তর-তর করে ছুটোছুটি করে। যখন সেই নির্দিষ্ট পথে আকস্মিক কোনো বিপদ এসে হাজির হয়, অর্থাৎ কোনো বাক্স বা কোনো ভারি জিনিসপত্র সেখানে পথ আগলে বসে, তখন সেটা অনায়াসে টুক করে বেয়ে তারা চলে যায়। কিন্তু রাত্রে আরও ভয়ংকর। এই বিশেষ সময়টাতে তাদের কার্যকলাপ আমাদের চোখের সামনে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শুরু হয়ে যায়। ঘরের যে কয়েকখানা ভাঙা কেরোসিন কাঠের বাক্স, কেরোসিনের অনেক পুরোনো টিন, কয়েকটা ভাঙা পিঁড়ি আর কিছু মাটির জিনিসপত্র আছে, সেখানে থেকে অনবরতই খুট-খুট টুং-টুং ইত্যাদি নানা রকমের শব্দ কানে আসতে থাকে। তখন এটা অনুমান করে নিতে আর বাকি থাকে না যে, ঝাঁক ঝাঁক ন্যুব্জদেহ অপদার্থ জীব ওই কেরোসিন কাঠের বাক্সের ওপরে এখন রাতের আসর খুলে বসেছে।
গল্পে গল্পাকার একজন সুকুমারের কথাই বলেছেন। বুঝতে অসুবিধা হয় না, লেখক নিজেকেই প্রতিস্থাপন করেছেন সুকুমারের মধ্যে। সোমেন চন্দ গল্পটি মার্ক্সবাদী চেতনা থেকেই লিখেছেন। মধ্যবিত্তের চেতনা ও ক্ষমতা আমরা জানি। তাদের জীবনের ইঁদুর দৌড়, হঠকারিতা, শঠতা, প্রবঞ্চনা, প্রতারণা এবং সুযোগসন্ধানী মনোভাব আমরা চিনি সুদীর্ঘকাল ধরেই। গল্পে মূলত উঠে এসেছে এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের কথাই। আবার গল্প কখনোই ইঁদুর থেকে দূরেও যায়নি। কখনো কখনো মানুষ হিসেবেও আমরা দেখি সেই ইঁদুরকেই। দ্বিতীয় অনুচ্ছেদেই গল্প ঢুকে যায় সমাজে আবার ফিরে ফিরে আসে ইঁদুরের জীবনে। ইঁদুর ও মানুষের জীবন মাঝেমধ্যেই একাকার হয়ে যায়। ইঁদুর মানুষকে ভয় পায়। তার প্রয়োজনেই তাকে আসতে হয় মানুষের কাছে, থাকতে হয় মানুষেরই মধ্যে। মানুষ সেটাকে উপদ্রুব হিসেবেই দেখে। ওদের তাড়নায় লেখক নিজেও উত্ত্যক্ত হয়েছেন। ইঁদুর মারার সামর্থ্য তাদের নেই। নেই প্রয়োজনীয় একটি ইঁদুর মারার কলও।
সুকুমারের মা ইঁদুরকে বড়ো ভয় করেন। দেখেছি একটি ইঁদুরের বাচ্চাও তার কাছে ভালুকের সমান। পায়ের কাছ দিয়ে দৌড়ে গেলে তিনিও ভয়ে চার হাত দূরে সরে যান। আবার ইঁদুরকে তিনি ভালও বাসেন। যে ইঁদুর বাড়িতে এতো অনাসৃষ্টি করছে, এত বিরক্তির কারণ সেই ইঁদুরের প্রতিও তার রয়েছে অনাবিল মায়া। আহা, মেরে কি হবে? অবোধ প্রাণ, কথা বলতে পারে নাতো। ইঁদুরের প্রতি এই টানের মধ্যে আমরা বুঝে নেই, আমরা সমাজে ও রাষ্ট্রে বাস করা ইঁদুরদের প্রতিও থাকি সহানুভূতিশীল। দরিদ্র পরিবারে প্রতিদিন দুধ আসে না। একদিন দুধ আসলে, সেই দুধে একটি ইঁদুর পড়ে গিয়ে নষ্ট করে দেয়। তা নিয়ে বাড়ির কর্তা শুরুতে কিছু না বললেও তার কষ্টটা বের হতেই থাকে আর তাতে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকেন কর্তী। তিনি ঢুকে পড়েন ছেলের কক্ষে। সেখানে মেঝেতে আঁচল পেতে কাচির মতো বাঁকা হয়ে শুয়ে পড়েন। মাও পরিণত হন একটি ইঁদুরে। লেখক বলেছেন, ‘ছোট বেলায় যাকে পৃথিবীর মতো বিশাল ভেবেছি, তাঁকে এমনভাবে দেখে কত ক্ষীণজীবী ও অসহায় মনে হচ্ছে। যাকে বৃহত্তম ভেবেছি, সে এখন কত ক্ষুদ্র, সে এখনও শৈশব অতিক্রম করতে পারেনি বলে মনে হচ্ছে’। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে একজন মায়ের অবস্থা একটি ইঁদুরের মতোই। দুঃখের সমুদ্রে যদি কেউ গলা পর্যন্ত ডুবে থাকে তবে তা এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি। ইঁদুর ধরার ফাঁদে তারা আটকে থাকে। এমন একটি উদাহরণ দিয়েই গল্পটি শেষ হয়েছে। বাড়িতে একদিন ইঁদুর ধরার কল আসে। সেখানে ধরা পড়ে কয়েকটি ইঁদুর। তাকে মারার জন্য সড়কে অপেক্ষা করে কয়েকজন তরুণ লাঠি ও ইট হাতে।
ফাঁদে ধরা পড়া ইঁদুর মারতে তারা খুবই আগ্রহী। ফাঁদের বাইরে থাকা ইঁদুর মারায় সেই আগ্রহ দেখা যায়নি। স্বামীর বীরত্ব দেখি স্ত্রী ও পুত্র-কন্যাদের উপর। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারও একটি ফাঁদ। বৃটিশ সাম্রাজ্যও একটি ফাঁদ। অসংখ্য ফাঁদেই মানুষ আটকে থাকে ইঁদুরের মতো। নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের জীবনও ইঁদুরেরই মতো। তাদের প্রাইভেসি বলতে কিছু থাকে না। এক কক্ষে যখন কর্তা কর্তীকে বাধ্য করে যৌনসংগম করতে তখন আরেক কক্ষে সেইসব শীৎকারের শব্দে পুত্র মরে যেতে থাকে, ক্ষতবিক্ষত হয় মন। আবার দুধ নষ্ট হওয়ায় সেই মাকেই যখন বাবা ‘শয়তান মাগি দূর হ’ বলে গালিগালাজ করে, কণ্ঠ নেমে যায় তুমি থেকে তুইতে তখনও সন্তানের মন ক্ষতবিক্ষত হয়। ইঁদুর সবকিছুই কেটে কুটিকুটি করে দেয়। আবার ইঁদুরের বাচ্চার মতোই এসব পরিবারে কিলবিল করে সন্তানেরা। বেড়ে উঠে অযত্নে, অবহেলায়। এই শ্রেণির মধ্যে শুধু আর্থিকই নয় রয়েছে মানসিক দীনতাও। এইসব সংকট তৈরি করে ইঁদুর চলার অনেক পথ। ইঁদুরেরা বাসা বানিয়ে নেয় আমাদের গহীন মনে আর কাঁটতে থাকে কুটকুট করে বন্ধন, মায়া, মমতা, ভালবাসা। এই যে মৌলবাদ আমাদের সংস্কৃতিকে কেটে কুটিকুটি করে দিতে চাচ্ছে-তাদের আচরণও ঐ ইঁদুরের মতোই। আজ যে আজিজ-বেনজীরদের দেখছি একেকটা ইঁদুরের মতো আমাদের সমাজকে ফুটা করে দিচ্ছে। এস. আলমরা লক্ষ কোটি টাকা পাচার করে আমাদের অর্থনীতিকে ফুটো করে দিচ্ছে। কেউ ধরিয়ে দিলে আমরা একটু লম্ফঝম্ফ করছি বটে তবে শিঘ্রই থেমেও যাচ্ছি। আমাদের রাজনীতি আমাদের কাছ থেকে ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে, জনমানুষকে নিক্ষেপ করেছে আস্তাকুঁড়ে। এক ইঁদুরের মধ্যে বহু রূপ দেখতে পাই। আবার ইঁদুর তাকে যতটা উত্ত্যক্ত করেছিল তার চেয়ে বেশি উত্ত্যক্ত করে দারিদ্রতা, পরিবারের নিম্নমধ্যবিত্ত মানসিকতা। সুকুমারের নিজের পরিবারটিও একটি ইঁদুরের পরিবারের মতোই।
এমন ফাঁদে পুরো ভারতের মানুষই ছিল। বৃটিশরা তাদের নিপীড়ন করতো, শুষে খেতো। দেশের মানুষ থাকতো অনাহারে, অর্ধাহারে। শাসকদের কারণে বারবার তাদের পড়তে হয়েছে দুর্ভিক্ষের কবলে। লেখক নিজে যেমন বাস্তব জীবনে জড়িয়ে ছিলেন রাজনীতির সাথে তেমনি গল্পের সুকুমারও জড়িয়ে ছিলেন শ্রমিক রাজনীতির সাথে। সাম্রারাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে তারা একটি সংগ্রাম গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। আর বৃটিশরা সচেষ্ট ছিল মানুষকে ইঁদুরের মতো ফাঁদে আটকে রাখতে। তিনি সেই ফাঁদ থেকে মুক্তি দেখে যেতে পারেননি। অবশ্য বাংলাদেশের মানুষ ধরা পড়েছিল পাকিস্তান নামের আরেক ফাঁদে। সেই ফাঁদ থেকেও মানুষ মুক্তি পেয়েছিল নাকি আটকা পড়েছে পুঁজিবাদ নামের আরো শক্ত এক ফাঁদে। গল্পটি পড়ে সবাই বলবে- এত অল্প বয়সে এত নিখুঁত লেখা। বেঁচে থাকলে নিশ্চয় দারুণ একজন বরেণ্য কথা সাহিত্যিক হয়ে উঠতেন। তাকে চাকু মেরে হত্যা করে প্রতিপক্ষ পার্টির মানুষেরাই। তিনি অত অল্প বয়সেই হয়েছিলেন প্রগতি লেখক সংঘের সেক্রেটারী। তাদের পত্রিকায় নিয়মিতই ছাপা হতো তাঁর লেখা। তাঁর রচনায় শক্তিশালী ভাষাই শুধু নয়, রয়েছে গভীর জীবনবোধ। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতোই শক্তিশালী ছিল তার ভাষা ও বোধ। সময় পেলে হয়তো হয়ে উঠতেন আমাদের শেষ্ঠ আরেকজন কথাসাহিত্যিক। ৭ জুলাই ২০২৪। ফেসবুক থেকে