পিপিপি ব্যবস্থা কেন কৃষি ও পরিবেশ উন্নয়ন খাতেও কার্যকর করা হবে না?
মারুফ আহমদ : বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) দেশের উন্নয়নের গতিপথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে পিপিপি অফিস স্থাপনের মাধ্যমে ২০১০ সালে সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই বিজয়ী সমাধানের জন্য পিপিপি মডেল গ্রহণ করে। এই উদ্যোগের লক্ষ্য ছিল মূল অবকাঠামো প্রকল্পে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকে গতিশীল করা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি করা ও সরকারি পরিষেবার উন্নতি ঘটানো। তারপর থেকে, উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ সফলভাবে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পিপিপি প্রকল্প সম্পন্ন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও সামিট বিবিয়ানা-২ পাওয়ার প্লান্ট। পিপিপি কর্তৃপক্ষের সর্বশেষ তথ্য (২৫ এপ্রিল ২০২৪) অনুযায়ী, ৮০টি পিপিপি প্রকল্প এখন পাইপলাইনে রয়েছে ও উন্নয়নের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। আনুমানিক ৪১.৬ বিলিয়ন ডলার এখন পর্যন্ত এই প্রকল্পগুলোর জন্য বিনিয়োগ করা হয়েছে। ৫.২ বিলিয়ন ডলারের আনুমানিক বিনিয়োগ সহ মোট ১৯টি স্বাক্ষরিত পিপিপি চুক্তি রয়েছে। যার মধ্যে ২টি কাজ চলছে ও ৯টি নির্মাণাধীন। ৪২টি প্রকল্প প্রকল্প উন্নয়নের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে, যখন ১৭টি প্রকল্প সংগ্রহের পর্যায়ে রয়েছে। এই প্রকল্পগুলো যথেষ্ট বিনিয়োগ আনতে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে ও সাসটেইনেবল উন্নয়নে অবদান রাখতে প্রত্যাশিত। নিয়ন্ত্রক কাঠামোকে স্ট্রীমলাইন করার ও বিনিয়োগ-বান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য ক্রমাগত প্রচেষ্টা জাতীয় প্রবৃদ্ধির জন্য পিপিপি ব্যবহার করার জন্য সরকারের প্রতিশ্রুতি নির্দেশ করে।
একটি প্রধান কৃষিপ্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ এখনো এ খাতে কোনো পিপিপি প্রকল্প চালু করেনি। ২০১২ সাল থেকে পিপিপি কর্তৃপক্ষ প্রায় ৮০টি প্রকল্পের তত্ত্বাবধান করেছে, যার মধ্যে একটিও কৃষিভিত্তিক প্রকল্প নেই। এর অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পিপিপি বাংলাদেশের কৃষি খাতে অনেকাংশে অব্যবহৃত রয়ে গেছে। যা নীতি নির্ধারকদের মনোযোগের দাবি রাখে। যদিও সরাসরি কেন্দ্রীয় পিপিপি কর্তৃপক্ষের এখতিয়ারের মধ্যে নয়, পল্লী উন্নয়ন একাডেমি, বগুড়া, একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। ২০০০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে এলজিআরডি মন্ত্রকের তত্ত্বাবধানে পিপিপি মডেল ব্যবহার করে কৃষি খাতে ছয়টি প্রকল্পের পাইলট করা। গবেষণা ও উন্নয়নের (আরএন্ডডি) অভিজ্ঞতা হস্তান্তরকারী এই জ্ঞান কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধি করতে পারে, গ্রামীণ উন্নয়নকে উৎসাহিত করতে পারে, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে পারে। কৃষি শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করতে, উদ্যোক্তাকে উৎসাহিত করতে ও অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য পিপিপির সুবিধা নেওয়ার জন্য বাংলাদেশের তিনটি উল্লেখযোগ্য সুযোগ রয়েছে। প্রথমত, কৃষি অবকাঠামোর আধুনিকীকরণ, উন্নত প্রযুক্তি স্থাপন, সাপ্লাই চেইনের দক্ষতার উন্নতি পিপিপি বিনিয়োগের মাধ্যমে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাড়াতে পারে। দ্বিতীয়ত, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও কৃষিভিত্তিক উৎপাদনও দেশের কৃষি উৎপাদনের সম্ভাব্য খাত।
বাংলাদেশ পিপিপি-র মাধ্যমে কৃষিতে কৌশলগতভাবে বিনিয়োগ করে উৎপাদনকে সর্বাধিক করতে ও প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারে। তৃতীয়ত, কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট কৃষকদের সানটেইনেবল অনুশীলন, উদ্ভাবনী চাষ পদ্ধতি, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও ব্যবসায়িক দক্ষতা শেখাতে পারে। এই সম্পূর্ণ পদ্ধতির মাধ্যমে বাংলাদেশের কৃষি-শিল্প, গ্রামীণ জনগোষ্ঠী ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পাবে। তাই, পিপিপি-র প্রচারের মাধ্যমে সরকার এই খাতকে উন্নত করতে, কৃষকের উৎপাদনশীলতা, বাজারে প্রবেশাধিকার বাড়াতে বেসরকারি বিনিয়োগ ও দক্ষতা অর্জন করতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের পিপিপি নীতির বাস্তবায়ন দ্রুত অবকাঠামো উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সম্প্রসারণে সহায়ক হয়েছে। চীন সরকার কৌশলগতভাবে পিপিপি ব্যবহার করে বেসরকারি পুঁজি সংগ্রহ, জনসেবা প্রদান বাড়ানো ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উদ্দীপিত করেছে। মহাসড়ক, রেলপথ ও শহুরে অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি বিশেষভাবে স্পষ্ট। উপরন্তু, চীন ক্রমবর্ধমানভাবে তার পিপিপি প্রকল্পগুলোতে পরিবেশগত বিবেচনাকে একীভূত করার দিকে মনোনিবেশ করেছে। সরকার বেসরকারি খাতকে সবুজ অবকাঠামো ও সাসটেইনেবল নগর উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করেছে। উল্লেখযোগ্য উদ্যোগগুলোর মধ্যে রয়েছে পরিবেশ-বান্ধব শহর নির্মাণ, সবুজ বিল্ডিং স্ট্যান্ডার্ডের ব্যাপক ব্যবহার ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পে বিনিয়োগ। উদাহরণস্বরূপ, শহুরে প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধান উদ্যোগের উপর ভিত্তি করে ‘স্পঞ্জ সিটি প্রজেক্ট’ একটি বিশিষ্ট উদাহরণ যেখানে শহরগুলোকে বৃষ্টির জল শোষণ, পুনঃব্যবহারের জন্য, বন্যার ঝুঁকি হ্রাস করা ও শহুরে স্থিতিশীলতা বাড়ানোর জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। চীনের পদ্ধতি দেখায় যে পিপিপিগুলো পরিবেশগত লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত ও উন্নয়ন প্রকল্পগুলো পরিবেশগত অখণ্ডতার সঙ্গে আপস করে না। যা সাসটেইনেবল উন্নয়ন ও পরিবেশ সুরক্ষায় উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখতে পারে। কৃষি খাতের মতো বাংলাদেশের পরিবেশগত উন্নয়ন খাতে এখনও কেবল পিপিপি থেকে কোনো বিনিয়োগ আসেনি। চীনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে, বসবাসযোগ্যতা উন্নত করার লক্ষ্যে শহুরে পরিবেশগত উন্নয়নে বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে।
সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণগুলো ইঙ্গিত করে যে বাংলাদেশের বেশিরভাগ শহর, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা, গ্রীষ্মের মৌসুমে ‘তাপ দ্বীপে’ পরিণত হয়েছিল। আমাদের শহুরে পরিবেশের মধ্যে সবুজ স্থান রক্ষা করা অপরিহার্য। অতএব, একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র যেখানে পিপিপি বিনিয়োগ যথেষ্ট প্রভাব ফেলতে পারে তা হলো পরিবেশগত উন্নয়নে। বিশেষ করে শহুরে নীল-সবুজ স্থান (ইউবিজিএস) উদ্যোগে। উদ্যান, জলাভূমি ও জলাশয়গুলোকে ঘিরে ইউবিজিএ, শহুরে স্থিতিশীলতা বাড়ানো, উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বায়ু ও জলের গুণমান, নান্দনিক আবেদনের বাইরে প্রসারিত বাসিন্দাদের জন্য বিনোদনমূলক স্থান প্রদান করে। ১২ মে ২০২৪-এ প্রকাশিত ‘ক্লাইমেট অ্যাকশন প্ল্যান ফর ডিএনসিসি এন্ড ডিএসসিসি’ -তে যেমন জোর দেওয়া হয়েছে, পিপিপি-র প্রচারের মাধ্যমে, বাংলাদেশ এই স্থানগুলোর বিকাশ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ব্যক্তিগত বিনিয়ো, দক্ষতা আকর্ষণ করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, পিপিপি নকশায় জড়িত হতে পারে, পরিবেশ বান্ধব পার্ক, গ্রিনওয়ে নির্মাণ, সাসটেইনেবল অনুশীলনকে একীভূত করা ও আরও সবুজ স্থান তৈরি করা। এই প্রকল্পগুলোর মধ্যে সক্রিয়ভাবে শহুরে জলাশয় পুনরুদ্ধার, পয়ঃনিষ্কাশন কেন্দ্র, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, বৃষ্টির জল সংগ্রহ, সবুজ ছাদ, পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি সমাধান ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। অধিকন্তু, বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ সবুজ স্থানগুলোর দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করতে পারে, তাদের দীর্ঘমেয়াদী কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে। সংক্ষেপে, কৃষি ও পরিবেশ খাতে একটি লক্ষ্যবস্তু ও সু-সঞ্চালিত পিপিপি বিনিয়োগ আগামী দশকে বাংলাদেশের উন্নয়নকে চালিত করতে পারে। যা অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং পরিবেশগত স্থায়িত্বে উৎসাহিত করতে পারে।
লেখক : সহকারী পরিচালক, পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (আরডিএ), বগুড়া। অনুবাদ : জান্নাতুল ফেরদৌস। সূত্র : ডেইলি সান