
আবেদ আলী যা করেছেন তা দুর্নীতি নয়, চুরি কিংবা ডাকাতি হতে পারে!

মোহাম্মদ আব্দুল বাতেন
আবেদ আলী যেটা করেছে এটা দুর্নীতি না। এটাকে দুর্নীতি বলে না। এটা চুরি কিংবা ডাকাতি হতে পারে। একটার সাথে আরেকটাকে গুলিয়ে ফেললে সমস্যা। দুর্নীতি হচ্ছে আপনি নীতি তৈরি করার কিংবা রক্ষা করার দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে যদি সেই নীতির অপব্যবহার করেন। তাই পিএসসি তে দুর্নীতি যদি হয়ে থাকে তাহলে সেটা আবেদ আলীদের না। এটা পিএসসির চেয়ারম্যান ও সদস্যদের। কারণ প্রশ্নপত্র তৈরি ও সেটাকে সুরক্ষিত রাখার জন্য তারা নীতিগতভাবে ক্ষমতায়িত। সেটা ফাঁস হলে নীতির বরখেলাপ তাহলে তাদের। সেই ক্ষেত্রে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হওয়া উচিত তাদের। এরপর আসবে তাদের অভিভাবক হিসেবে সেই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর।
নীচের লেভেলের চোরদের শাস্তি আইন অনুযায়ী হবে, সমস্যা নাই। কিন্তু‘ চোরদের চুরি করার সুযোগ তৈরির দায় তো নীতি রক্ষকদের, সেখানে ব্যবস্থা না নিলে আবেদের জায়গায় জাভেদ আসবে দুর্নীতিতো কমবে না। দুর্নীতি একটা সিস্টেমিক প্রবলেম, ব্যক্তির লোভ লালসার ইস্যু না। আমরা এটাকে ব্যক্তির লোভ লালসা লেবাসে রিডিউচ করে ফেলে মুল সমস্যার কেন্দ্র যারা তাদের দায়মুক্তি দিয়ে ফেলি। আবেদ আলীদের নামাজের ছবি, হজ্বের ছবি ভাইরাল করে জনগণ যে সুখ পাচ্ছে এতে কিছু কি দুর্নীতি বিরোধী অবস্থান জোরদার হচ্ছে? আমার মতে, হচ্ছে না। কারণ আলোচনা ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে সিস্টেম দায় মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে। আবার জনগণের বৃহদাংশের ক্ষোভ দেখে মনে হচ্ছে, এটা ক্লাস কনফ্লিক্ট। আমাদের সমাজে ড্রাইভার (লোয়ার ইকোনোমিক ক্লাস) যে ইকোনোমিক ক্লাসে বিলং করার কথা, সেটা থেকে আবেদ আলী অন্য ক্লাসে (যেভাবেই হোক) উত্তরণ করায় বেশিরভাগ ক্ষুব্ধ। এখন আবেদ আলী এত ধন-সম্পত্তি না করলে সে চুরি করলেও জনগণ মনে হয় না এত ক্ষিপ্ত হতো। ক্লাসের বর্ডার লাইন নিয়ে মানুষের এই সাবকনসাস অবেসশন একধরনের সোশ্যাল ক্যাভেট। সেটা নিয়ে আরেকদিন আলোচনা করবো।
আবেদ আলী ও তার পুত্র নামাজের নানা এঙ্গেল ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেওয়াটাকে আমি মনে করি আমাদের সমাজের কালেকটিভ কনসাসনেশের প্রতিচ্ছবি। কারণ আমাদের সমাজে ধর্মাচারকে নৈতিকতার মানদণ্ড হিসাবে দেখা হয়। কে নামাজ পড়ে, কে রোজা রাখে এগুলোকে মানুষ সৎ, ভালো মানুষ হিসেবে গণ্য করার সোশ্যাল যে কনসেনশাস, সেটাই যুগ যুগ ধরে ব্যবহার করে আসছে রাজনীতিবিদ, অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী, দুর্নীতিবাজ,ঘুষখোর রা। আমরা হালাল মাংস নিয়ে অবসেসড, হালাল ইনকাম নিয়ে না। তাই তো আবেদ আলীরা বলে প্রশ্ন ফাঁসের টাকা সে আল্লাহর রাস্তায় খরচ করেছে। আবেদ আলীকে তৈরির পেছনে সমাজ কি তাহলে পরোক্ষভাবে দায়ী নয়? তাই এই সমাজে দুর্নীতি কখনোই বড় ইস্যু ছিলো না, বরং এর থেকে বড ইস্যু ছিলো কে ধর্মীয় আচার পালন করে আর করে না। তাই সবাই মনে করে তার জীবিকার অর্জন পন্থা সোশ্যাল ভ্যালিডেশন পেয়ে যাবে যদি সে সমাজে ধার্মিক কিংবা ধর্মের সেবক হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
তাই মতিউর সাক্ষাৎকারে মার্কেটে ছেড়ে দেয় তার ছেলে ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, সপ্তাহে দুই দিন রোজা রাখে। আবেদ আলীর ছেলে তার বাবার নানা এঙ্গেলের নামাজরত ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। কোনো স্বৈরাচার রাষ্ট্রপতি আজীবন লুইচ্ছামী করেও রাষ্ট্রধর্ম জুড়ে দিয়ে রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক থেকে যায়, কেউ সংবিধানে ধর্মীয় বিধান যোগ করে অবৈধ ক্ষমতা দখল করেও বৃহৎ রাজনৈতিক দল গঠন করে বারবার ক্ষমতায় যায়। সে একই ধারাবাহিকতায় কেউ নির্বাচনের আগে হজ্ব করে তসবি গোনার ছবি ছড়িয়ে দেয়।
ধর্ম ব্যক্তিগত। ধর্ম আমার সাথে আমার স্রষ্টার কানেকশন। কিন্তু এটাকে যখন সোশ্যাল রেজিস্ট্রি, মোরাল ও এথিক্সের সর্বোচ্চ মাধ্যম হিসাবে সমাজ প্রতিষ্ঠা করে সেই সমাজে ধর্মীয় আস্তিনে দুর্নীতি, অনিয়ম আশ্রয় নেবে এটা বুঝা রকেট সায়েন্স না। আবেদ আলী, মতিউর, বেনজীরকে তৈরি করার পেছনে এই সমাজের দায় ও আছে। কারণ এই সমাজ প্রশ্ন করতে বাধা দেয়। আর প্রশ্ন করতে বাধা দেওয়ার প্রাথমিক প্রাকটিস শুরু হয় ধর্ম থেকে। যদিও নৃতাত্ত্বিক তত্ত্ব মতে ধর্মগুলো প্রতিষ্ঠাই হয়েছে মানুষের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে।
ধর্ম নৈতিকতার একটা উৎস। কিন্তু একমাত্র ও সবচেয়ে শক্তিশালী উৎস কিনা এটা নিয়ে বিতর্ক আছে। মানুষের ব্যক্তিগত ধর্মাচারণকে যখন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ন্যায়বিচারের এক্সপ্রেশন হিসাবে সোসাইটি ভ্যালিডেশন দিচ্ছে তখন অনাচার সেই সুযোগ নিবেই। ধর্মগুলো ব্যক্তিগত ভার্চু নিয়ে যতটা ক্লিয়ার, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দুর্নীতি নিয়ে অতটা ক্লিয়ার না। কারণ ধর্মগুলো যখন উৎপত্তি হয় তখন আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা ছিলো না। সমাজ এত জটিল ছিলো না। সেই কারণেই রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে ধর্মকে পৃথক করা জরুরি। চোখ বন্ধ করে চিন্তা করেন যেসব রাষ্ট্র তুলনামূলক দুর্নীতিকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পেরেছে এবং সামাজিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে সেখানে রাষ্ট্র ও ধর্ম পৃথক কিনা? জনগণ ধর্মীয় আচার নিয়ে পাবলিককি আদিখেতা দেখায় কিনা?
ধর্মে সব প্রশ্নের উত্তর নেই। এটা সহজ সত্য। কারণ ধর্ম আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে টার্গেট করে ইভলভড হয়নি। তবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ধর্মের উপযোগিতা আছে। মানুষের স্পিরিচুয়াল নিডের জন্য। কিন্তুÍ সেটা সোশ্যাল ও লিগ্যাল ভ্যালিডেশনের কোন মাধ্যম হতে পারে না। ধর্ম ইন্টারনাল স্যালেভেশনের ইস্যু। নামাজি, পরহেজগার পাত্র কিংবা পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন দিয়ে জীবন সংগী খোজার যে নৈতিক স্টান্ডার্ড তৈরি করেছি সেটাই আমাদের সামাজিক একটা উদাহরণ কিভাবে সমাজ সৎ ও যোগ্য মানুষ খোজে। কিন্তুÍ এইগুলো সোশ্যাল স্টান্ডার্ড না। হওয়া উচিত ছিলো সৎ, ট্রাষ্ট্রেড ও হালাল ভাবে জীবিকা অর্জন করে কিনা সেটা পরখ করা। লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান, ইউনিভার্সিটি অব মেইন, যুক্তরাষ্ট্র
