
২০০২ থেকে ২০০৬ : পিএসসির ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে সময়
শরিফুল হাসান
চারপাশে অনেকের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে এই দেশে বিসিএসের প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি যেন ডালভাত এবং যারা বিসিএস ক্যাডার হন তাঁরা বুঝি প্রশ্নপত্র পেয়েই ক্যাডার হন। আমি বরং বলবো যারা বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন তাদের বেশিরভাগই নিজের চেষ্টা ও যোগ্যতায় বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন। এখানে ঢালাওভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথা বলা অবান্তর। আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, পিএসসি থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা কি তবে ঘটে না? পিএসসির কোনো সমস্যা কি নেই? উত্তরে আপনাকে বলি, আছে। পিএসসির নানা সমস্যা আছে। পিএসসির বহু কিছু ত্রটিপূর্ণ। বিসিএসের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনেক অস্বচ্ছতা আছে। তবে সেসব নিয়ে আলোচনা করতে গেলে বিসিএস আর নন ক্যাডারের নিয়োগ পরীক্ষা এই দুটি বিষয় আলাদা করে আলোচনা করতে হবে। আসলে এই দেশে নন ক্যাডারের বিভিন্ন নিয়োগে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা কম বেশি অনেকদিন ধরেই ঘটছে। কেউ যদি আমাকে বলে এই দেশের সব নন ক্যাডার পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কম-বেশি ফাঁস হয়েছে এবং কোনো না কোনো অনিয়ম হয়েছে আমি সেটাকে উড়িয়ে দেব না। এখানে ভয়াবহ অনিয়ম হয়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় বিসিএসের নিয়োগপ্রক্রিয়া এতোটা নষ্ট হয়নি। তবে এখানে অনেকগুলো ত্রুটি আছে। তবে তার মানে এই নয় যারা নিয়োগ পেয়েছেন তারা প্রশ্নপত্র কিনে নিয়োগ পেয়েছেন। আপনারা যারা নিয়োগ পরীক্ষা দেন তারা জানেন, ডিজিটাল ডিভাইসের কারণে গত ১৫ বছরে নানা নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস মহামারি আকার ধারণ করেছে। বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তো ধারাবাহিকভাবেই ফাঁস হয়েছে বিশেষ করে যারা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র করার দায়িত্বে ছিল সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর কেউ না কেউ এসব কাজে জড়িত ছিলেন। আমি নিজে একাধিক প্রমাণসহ এসব নিউজ করেছি।
এসব কারণেই কিন্তু পিএসসির প্রয়াত চেয়ারম্যান সা’দত হুসাইন স্যার নন ক্যাডারের পরীক্ষা কমিয়ে বিসিএস থেকে নন ক্যাডারে নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আমি মনে করি নন ক্যাডারের নিয়োগ যতো কম হবে ততো প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঝুঁকি কমবে এবং নিয়োগবাণিজ্য বন্ধ হবে। বিসিএস নিয়ে বলি এবার। স্বাধীনতার পরের পিএসসির ইতিহাস আমার জানা নেই। তবে ১৯৯১ সাল থেকে আজ অব্দি যারা পিএসসির চেয়ারম্যান হয়েছেন সেই আটজন চেয়ারম্যান সম্পর্কে আমার কম বেশি জানা আছে এবং এদের মধ্যে ছয়জনের সঙ্গে আমার কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। আসলে অতীতে পিএসসি নিয়ে খুব বেশি কলঙ্কের কথা শুনিনি যতোটা শুনেছি ২০০২ থেকে ২০০৬ এই সময়কার। তখন পিএসসির চেয়ারম্যান ছিলেন ড. জেড. এন. তাহমিদা বেগম। ২০০২ সালের মে মাস থেকে ২০০৭ সালের মে এই সময়টায় তিনি পিএসসির চেয়ারম্যান ছিলেন। এই সময়ে বিসিএসসহ নানা নিয়োগে বেশ বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে। ২০০৫ সালে ২৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। ওই সময় অনুষ্ঠিত ২৭তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়। নন ক্যাডারে নিয়োগ বাণিজ্য আর প্রশ্নপত্র ফাঁস ছিলো খুব সাধারণ বিষয়। আমি বলবো, ২০০২ থেকে ২০০৬ এই সময়টা পিএসসির ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে সময়। ওই সময়ের যারা নিয়োগ পরীক্ষা দিয়েছিলেন তারা এগুলো কম বেশি জানেন। পিএসসির ওই সময়কার সদস্য অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান একটা চক্র খুলে বসেছিলেন। আজকের আবেদ আলী তাদের সৃষ্টি। ফখরুদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রকাশিত প্রথম ৫০ জন সন্দেহভাজন ‘দুর্নীতিবাজের’ তালিকায় এই অধ্যাপক মাহফুজের নাম ছিল।
অধ্যাপক মাহফুজুরের বিরুদ্ধে ২৭তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষায় ঘুষ গ্রহণসহ পরীক্ষায় অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তবে এই খারাপ সময়েও যে যারা ক্যাডার হয়েছেন তারা সবাই খারাপ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পেয়েছেন তা নয়। তবে অনেক অযোগ্য লোক এ সময় চাকরিতে নিয়োগ পেয়েছেন। তবে অনিয়ম ছিলো বহু। জরুরি অবস্থা চলাকালে ২০০৭ সালের ৯ মে সা’দত স্যার পিএসসির দায়িত্ব নেন। তাঁর সঙ্গে আমি ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি। সা’দত স্যার শেষের দিকে সরকারের কাছ থেকে যথেষ্ট সহযোগিতা পাননি। ২০০৭ থেকে ২০২০ এই সময়ে সাংবাদিক হিসেবে পিএসসিকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। এই সময়ে কোনো বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে এমনটা আমার অন্তত জানা নেই। তবে ২০১২ সালে ৩৩ তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় এবং আমি নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে প্রশ্নপত্র পাওয়ার বিষয়টি পিএসিসকে জানাই। ততোদিনে সা’দত স্যার চলে গিয়েছেন এবং পিএসসির দায়িত্ব নিয়েছেন অবসরে থাকা পুলিশ কর্মকর্তা এ. টি. আহমেদুল হক চৌধুরী। তিনি এবং ওই সময়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নেছার উদ্দিন সাহেবকে আমি এসব প্রশ্নপত্র নিজে গিয়ে দিয়ে আসি। ওই পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে।
এর বাইরে গণহারে বিসিএসের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে এটা অবান্তর। বরং ২৮তম বিসিএস থেকে শুরু করে ৪১ পর্যন্ত বিসিএসগুলোতে যারা নিয়োগ পেয়েছেন তারা অধিকাংশ এই দেশের কৃষক বা সাধারণ পরিবারের সন্তান। এখানে ঢালাওভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথা বলা অবান্তর। আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, পিএসসিতে কী তাহলে অনিয়ম হয়নি? আমি এই প্রশ্নের উত্তরে আগেই বলেছি পিএসসিতে অনেক অনিয়ম ছিলো, এখনো আছে। একটা ঘটনা বলি। ২৯তম বিসিএসের প্রথম যিনি হয়েছিলেন এবং পরে পুলিশ ক্যডারে নিয়োগ পান তিনি কীভাবে প্রথম হয়েছিলেন সেটি অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমি এমন কিছু ঘটনা জেনেছি যাতে মনে হয়েছে কেউ যদি কোটি টাকা খরচ করতে চান এবং পিএসসির প্রভাবশালী কোনো সদস্য বা পরীক্ষা নিয়ন্ত্রককে বিপুল পরিমাণ টাকা দেন তাহলে বিসিএসে প্রথম হওয়াও সম্ভব। তাঁর মানে যেকোনো ধরনের দুর্নীতি সম্ভব পিএসসিতে। কোনোদিন পারলে এ নিয়ে বিস্তারিত লিখবো। প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে যারা কাজ করছেন তারা চাইলে ২৯তম বিসিএসে প্রথম হওয়া এই ছেলেটির সঙ্গে কথা বলুক। তিনি সত্য বললে পিএসসির এমন একটা অনিয়মের সন্ধান মিলবে যেটি অজানা। এ ছাড়া এই সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া পিএসসির একজন সদস্য যিনি একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ছিলেন তাঁর বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আমার। তবে সব ছাড়িয়ে পিএসসিতে দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্ব পালন করা একজন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রককে আমি সন্দেহ করি। এই চক্রটা খুব শক্তিশালী।
শুনলে অবাক হবেন এই যে কোটা পদ্ধতির প্রয়োগ হতো পিএসসির বেশিরভাগ সদস্য বলতে পারবেন না কীভাবে কোটার জটিলভাগটা হয়। ওই পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এগুলো করতেন। আমি তাঁর বিষয়ে পিএসসির তিনজন চেয়ারম্যানকে বলেছি এবং কোনো চেয়ারমানই তাঁর বিরুদ্ধে কিছু করতে পারেননি। আরেকটা কথা বলি। জনপ্রশাসন মন্ত্রী ছিলেন সৈয়দ আশরাফ। এই মানুষটা পিএসসিতে অবারিত স্বাধীনতা দিয়েছেন এবং কখনো হস্তক্ষেপ করেননি। তবে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী একজন আমলা ছিলেন যিনি এখন প্রয়াত তিনি বিসিএসের নিয়োগে এমন কিছু কাজ করেছেন যেটি পিএসসির কলঙ্ক হয়ে থাকবে। আমার কাছে পিএসসির বড় কলঙ্ক এটা। এর চেয়ে বড় অনিয়ম আর হতে পারে না। কোনোদিন সুযোগ পেলে আমি এসব নিয়ে লিখবো। তবে আবারো বলি এতোকিছুর পরেও মোটাদাগে বিসিএসের নিয়োগ পরীক্ষা মোটামুটি স্বচ্ছ। সাধারণ ছেলেমেয়েদের ৫০-৬০ লাখ টাকা খরচ করে বিসিএসের চক্রে প্রবেশের সুযোগ ছিলো না। তবে কেউ কেউ সেই সুযোগ নেননি এমনটা বলা যাবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত এদের খুঁজে বের করা?। কারণ অনিয়ম মানে শুধু প্রশ্নপত্র ফাঁস নয় আরো বহুভাবে অনিয়ম হয়েছে এবং ওই উপদেষ্টা যা করেছেন সেটা আমার চোখে পুরো একটা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা?। এমন কিছু অনিয়ম সবসময় হয়েছে।
এবার আসি চ্যানেল টুয়েন্টিটুরের প্রতিবেদেনে। ওই প্রতিবেদনে বলছে, ৪৫ ও ৪৬ তম বিসিএসের প্রিলিমিনিরি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। এই ঘটনা ঘটেছে পিএসসির বর্তমান চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইনের আমলে। পিএসসির এই চেয়ারম্যানের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুযোগ হয়নি। কাজেই এই অভিযোগ সত্য হলে অবাক হবো না?।? কারণ আগেই বলেছি, নন ক্যাডারে বারবার প্রশ্নপত্র ফাঁস হতো বলে সা’দত স্যার বিসিএস থেকে নন ক্যাডারে নিয়োগের উদ্যোগ নেন বর্তমান চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন সেই উদ্যোগকে সংকটে ফেলেছেন। এ কারণে তাঁর প্রতি আমার সন্দেহ আছে। আরেকটা কথা, যখন তিনি শিক্ষা সচিব তখন গণহারে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। কাজেই তাঁর সম্পর্কে আমি বিস্তারিত মন্তব্য করবো না। আমি সরকারে থাকলে এমন একজনকে পিএসসির চেয়ারম্যান করতাম না। সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার সুমন আরেকটা বিষয় উল্লেখ করেছেন। দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন পিএসসির সদস্য হয়েছেন যেটা হতাশার। যখুনি এই ধরনের কোন সদস্য পিএসসিতে যুক্ত হয়েছেন নানা অঘটন ঘটেছে।
চ্যানেল টুয়েন্টিফোর ইতিমধ্যেই রেলওয়ের ৫১৬টি পদের নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা জানিয়েছে। এই পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে পিএসসির দুজন উপপরিচালক, একজন সহকারী পরিচালকসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। এর মধ্যে পিএসসির সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী ও তাঁর ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান ওরফে সিয়ামও রয়েছেন। এই চক্রের সঙ্গে ওপরের কারো না কারো যোগসূত্র আছেই। আসলে প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া উচিত নয়। এই চক্রের কাছ থেকে টাকা নিয়ে যার চাকরি পেয়েছে তাদের প্রত্যেককের নাম প্রকাশ ও চাকরি থেকে বরখাস্ত করা উচিত। জানি না বর্তমান চেয়ারম্যান কীভাবে এই দায় এড়াবেন। কী জবাব দেবেন!
শেষ করি এই কথা বলে যে পিএসসি নিয়ে আমার দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছে বিসিএসের নিয়োগ পরীক্ষা আরো স্বচ্ছ ও ভালো করার সুযোগ আছে। কারণ এখনো নানা অনিয়ম হয়। আমি মনে করি প্রিলিমিনারি পরীক্ষা থেকে শুরু করে সব পরীক্ষার নম্বর ও মেধাক্রম প্রকাশ করা উচিত। মৌখিক পরীক্ষার নম্বর কোনোভাবেই ২০০ রাখা উচিত নয়। কারণ মৌখিকে একেকটা বোর্ড একেকরকম নাম্বার দেন এবং এখানে স্বজনপ্রীতির সুযোগ আছে। ২৭ ও ৩৪ তম বিসিএস এর বড় উদাহরণ। এছাড়া কোটা সংস্কার জরুরি। তবে তার চেয়েও জরুরি নন ক্যাডারের এতো এতো নিয়োগ পরীক্ষা বন্ধ করে বিসিএস থেকে সারাবছর প্রার্থী নেওয়া। শুধু কর্মকর্তা নয় কর্মচারী নিয়োগেও স্বচ্ছ করা জরুরি। আর একটা দেশকে ঠিক করতে হলে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ হওয়া উচিত। তবে এর চেয়েও জরুরি নানা ক্যাডার ও পদে বৈষম্য দূর করা। সবচেয়ে জরুরি একটা দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। কারণ সুশাসন না থাকলে অনিয়ম দুর্নীতি থাকলে কেবল পিএসসি কেন সেই ছাপ পড়বে সর্বত্র। কাজেই এই দেশটা ঠিক করতে হলে দুর্নীতি লুটপাটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি। লেখক: কলামিস্ট
