
ভবিষ্যতে শৈবাল অত্যাবশ্যক বিকল্প খাদ্য হওয়ার সম্ভাবনা আছে!
অলোক আচার্য্য : খাদ্য ও জ্বালানি সংকট ভবিষ্যত বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দেবে। এই সমস্যার সমাধান নির্ভর করবে বিজ্ঞানীরা কীভাবে বিকল্প উৎস থেকে খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারেন তার ওপর। এই বিকল্পের তালিকায় অনেক খাবার রয়েছে। যেমন কৃত্রিম মাংস। তবে তালিকায় আরও একটি বিকল্প রয়েছে। শেত্তলাগুলো হলো এক ধরনের আলো-সংশ্লেষণকারী, ফুলবিহীন উদ্ভিদ যা সাধারণত সমুদ্র বা নদীর তলদেশে জন্মে। এর কোনো শিকড়, কান্ড বা পাতা নেই। সারা বিশ্বে তিন ধরনের সামুদ্রিক শৈবাল পাওয়া যায়: লাল, বাদামী ও সবুজ। শৈবাল পৃথিবীর মোট সালোকসংশ্লেষণের ৬০ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব করে। সামুদ্রিক শৈবালকে সুপার ফুড বলা হয় ও বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত সামুদ্রিক শৈবাল নিয়ে গবেষণা করছেন। বিজ্ঞানীরা একটি স্টাডিতে দাবি করেছেন যে সামুদ্রিক শৈবাল ভবিষ্যতের খাদ্য ও শক্তি সরবরাহের অন্যতম উৎস হতে পারে। শৈবাল রূপান্তর ইউরোপে ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। সামুদ্রিক শৈবাল কীভাবে শুকানো যায় ও কীভাবে ব্যবহার করা যায় তা নিয়ে এশিয়ার দেশগুলোও প্রচুর গবেষণা করছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৬৪০ সালের দিকে জাপানের টোকিও উপসাগরে প্রথম সামুদ্রিক শৈবাল চাষ শুরু হয়। এছাড়া প্রথম বাণিজ্যিক সামুদ্রিক শৈবাল চাষের যাত্রা শুরু হয় ১৯৪০ সালে। অর্থাৎ খাদ্য হিসেবে শৈবালের যাত্রা শুরু হয় বহু বছর আগে। বিজ্ঞানীরা খাদ্য চাহিদা মেটাতে বিকল্প উৎস খুঁজছেন। কৃত্রিমভাবে উৎপাদিত শেওলা বিভিন্ন ধরনের ওষুধ, টুথপেস্ট, প্রসাধনী ও পশুখাদ্য তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন মানের কাপড় (প্লাস্টিকের বিকল্প), ক্যাপসুলের খোসা, পাইপ তৈরি করাও সম্ভব। সমুদ্র আগে থেকেই বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ। সমুদ্র থেকে আহরিত মাছ ও বিভিন্ন সামুদ্রিক সম্পদ সরাসরি মানুষের জীবন-জীবিকার সঙ্গে জড়িত।
এতে শৈবাল যোগ করলে সমুদ্রের গুরুত্ব অন্য মাত্রায় বেড়ে যেতে পারে। যদিও সামুদ্রিক শৈবাল ব্যবহার করে তৈরি খাবার মানুষের কাছে পৌঁছেছে কিন্তু পরিমাণ খুব বেশি নয়। কিন্তু বিশ্বের অনেক মানুষ খাদ্য সংকটে রয়েছে। সারা বিশ্বে সাগর অর্থনীতি নিয়ে বেশ জোরেশোরে আলোচনা হচ্ছে। এই শৈবাল ব্যবহার করে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা সম্ভব। বিশ্বের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বিশাল জনসংখ্যার জন্য বিপুল পরিমাণ খাদ্যের প্রয়োজন। আর এখন পর্যন্ত খাদ্য চাহিদা মেটানোর প্রধান ভরসা কৃষি জমি। কিন্তু দেশের কৃষিজমি যে হারে সংকুচিত হচ্ছে তা একদিন পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদনকে হুমকির মুখে ফেলবে। এই সমস্যার একটি চমৎকার সমাধান হতে পারে এই সুপার ফুড। যা সমানভাবে পুষ্টির চাহিদা মেটাতে পারে। তাছাড়া এতো বিশাল এলাকা নিয়ে আমাদের সমুদ্র সীমানা চাইলেই খাদ্য চাহিদা মেটাতে ব্যবহার করা যেতে পারে। তিন ধরনের শেত্তলাগুলোর মধ্যে, সবুজ খাদ্য হিসেবে সবচেয়ে বেশি খাওয়া হয়। আর হাইড্রোকলয়েড উৎপাদনে লাল ব্যবহার করা হয়। বাদামী শেত্তলাগুলো খাদ্য ও হাইড্রোকলয়েড উভয় উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী সামুদ্রিক চাহিদা প্রায় ২৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন। এর বেশিরভাগই এশিয়ার দেশগুলোতে (চীন, জাপান, ফিলিপাইন, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া) উৎপাদিত হয়। যা মোট চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ উৎপাদন করে। চীনের বিশ্বব্যাপী শৈবাল বাজারের একটি বড় অংশ রয়েছে। চীন একাই মোট চাহিদার প্রায় ৪০ শতাংশ উৎপাদন করে। বর্তমানে, ২৬ মিলিয়ন টন সামুদ্রিক শৈবালের মোট মূল্য ৬.৫ বিলিয়ন ডলার। ২০১২ সালে বিশ্বব্যাপী সামুদ্রিক শৈবাল উৎপাদনের ৪০ শতাংশ সরাসরি মানুষের খাদ্য হিসেবে, ৪০ শতাংশ পরোক্ষভাবে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য হিসেবে ও অবশিষ্ট ২০ শতাংশ শিল্পে ব্যবহৃত হয়েছিল।
জাপানের জিডিপির ২১ শতাংশ আসে সামুদ্রিক শৈবাল ও এর পণ্য রপ্তানি থেকে। চীনের ১৪-১৫ শতাংশ জিডিপি ও কোরিয়ার ৮-১০ শতাংশ জিডিপি গড়ে এই খাত থেকে আসে। ইউএন কমট্রেডের পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০১৯ সালে ৯৮টি দেশ সামুদ্রিক শৈবাল (৯০৯ মিলিয়ন ডলার) ও সামুদ্রিক শৈবাল-ভিত্তিক হাইড্রোকলয়েড (১.৭৪ বিলিয়ন ডলার) রপ্তানির মাধ্যমে ২.৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে। শৈবাল সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল। শেত্তলাগুলো সূর্যালোক, পুষ্টি ও সমুদ্রের জল থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে শক্তিতে বেঁচে থাকে। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে শেত্তলাগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কার্বন সিকোয়েস্টেশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু শেত্তলা থেকে সরাসরি ফাস্টফুড তৈরি করা অনেক লম্বা পথ। কারণ যারা শৈবাল নিয়ে কাজ করেন তাদের মতে, শৈবালকে দ্রুত প্রক্রিয়াজাত করা যায় না, খাবার তৈরি করতে অনেক ধাপ অতিক্রম করতে হয় যা কিছুটা জটিল প্রক্রিয়া। এখানে প্রযুক্তিগত জটিলতা আছে। যদি এটি সহজ হয়, সমুদ্র শৈবাল দ্রুত মেনুতে জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। শৈবাল শুকানোর কোনো কার্যকরী পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি। রোদে শুকানোর সময় শৈবালের গুণমান অনেক কমে যায়। আবার শৈবাল বোডজ থেকে জলীয় অংশকে আলাদা করার যান্ত্রিক পদ্ধতি অনেক বেশি ব্যয়বহুল। শৈবালের উপকারিতা বহুমুখী। কারণ এই সুপার ফুড পুষ্টিগুণে ভরপুর। এতে প্রোটিন, ভিটামিন, আয়রন, চর্বি, শর্করা, বিটা-ক্যারোটিন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন, সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সালফার, তামা, জিঙ্ক, কোবাল্ট ও আয়োডিন রয়েছে। এছাড়াও আরও অনেক ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার রয়েছে, যেমন শেওলা। স্পিরুলিনা শৈবাল বডিজের হজম শক্তি বাড়ায়, প্যাথোজেন থেকে রক্ষা করে ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। যা এইডস প্রতিরোধে সাহায্য করে। গবেষকদের মতে, ১০০ গ্রাম স্পিরুলিনায় ৩৭৪ কিলোক্যালরি থাকে। ১০০ গ্রাম স্পিরুলিনার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ প্রোটিন। এছাড়া এতে রয়েছে উচ্চ মাত্রায় আয়রন, পটাশিয়াম, জিঙ্ক ও ক্যালসিয়াম। গবেষকরা বলছেন, এই স্পিরুলিনা শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই খেতে পারেন। সি হুড মিল্কশেক নামক এক ধরণের খাবার সামুদ্রিক শৈবাল থেকে তৈরি করা হয়, সকালের নাস্তা ও ভাতের সঙ্গে খাওয়া যায়। বায়োফুয়েল, বায়োইথানল, বায়োহাইড্রোকার্বন, বায়োহাইড্রোজেন ইত্যাদি গাড়ির জ্বালানি হিসেবে পাওয়া যায় ও পাঁচ প্রজাতির শৈবাল থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। সুতরাং, ভবিষ্যতের জন্য শৈবালের একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যত রয়েছে।
লেখক : কলামিস্ট ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। অনুবাদ : জান্নাতুল ফেরদৌস। সূত্র : ডেইলি অবজার্ভার
