১.৭৫ বিলিয়ন ডলার বকেয়া নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ বিভাগ
মো. আখতারুজ্জামান : [১] ডলার সংকটের জন্য বিপিসি ও পেট্রোবাংলার বকেয়া তৈরি হয়েছে। যদিও এ সংস্থাগুলোর পর্যাপ্ত তহবিল রয়েছে, এগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা পাচ্ছে না।
[২] এলএনজি, জ্বালানি তেল ও বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ কুপ থেকে গ্যাস উত্তোলন বাবদ বকেয়া পাওনা ১.৭৫ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি দাঁড়ানোর ফলে দেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ বিভাগ উল্লেখযোগ্য আর্থিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে।
[৩] জ্বালানি বিভাগের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, ৭ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) ২৩০ মিলিয়ন ডলার এবং বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ কর্পোরেশনের (পেট্রোবাংলা) ৭৮০ মিলিয়ন ডলার বকেয়া তৈরি হয়েছে। [৪] পেট্রোবাংলার মোট বকেয়ার ৪৫০ মিলিয়ন ডলার এলএনজি আমদানি বাবদ। শেভরন দেশের ভেতরের গ্যাসক্ষেত্র থেকে উত্তোলন করা গ্যাস সরবরাহের জন্য ২৫০ মিলিয়ন ডলার পাবে সংস্থাটির কাছ থেকে।
[৫] অন্যদিকে ঋণদাতা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইটিএফসি) পাবে ৮০ মিলিয়ন ডলার। জ্বালানি বিভাগের ওই প্রতিবেদন দেখেছে।
[৬] সূত্র জানায়, ডলার সংকটের জন্য বিপিসি ও পেট্রোবাংলার বকেয়া তৈরি হয়েছে। যদিও এ সংস্থাগুলোর পর্যাপ্ত তহবিল রয়েছে, এগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা পাচ্ছে না। পাশাপাশি বকেয়া দেনার জন্য দিতে হচ্ছে জরিমানাও।
[৭] বিদ্যুৎ বিভাগের সূত্র অনুসারে, ভারতের আদানি গ্রুপ বিদ্যুৎ সরবরাহ বাবদ ৬০০ মিলিয়ন ডলার পাবে। এছাড়া ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে সরবরাহকৃত বিদ্যুতের জন্য ১০০ মিলিয়ন ডলার বিল বকেয়া রয়েছে।
[৮] এর বাইরে কলয়া আমদানির বিলও বকেয়া আছে বলে জ্বালানি বিভাগসূত্রে জানা গেছে। ৭ জুলাই, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী চলমান সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
[৯] চীন সফর শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর তাকে এসব বিষয়ে অবহিত করা হবে বলে জানান তিনি। প্রতিমন্ত্রী বকেয়া নিষ্পত্তির জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়ারও পরিকল্পনা করছেন।
[১০] ৮ জুলাই জ্বালানি সচিব মো. নূরুল আলম টেলিফোনে টিবিএসকে বলেন, এ বছর বিদ্যুৎ খাতে বেশি গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে এবং স্পট মার্কেটে দাম কমার কারণে এলএনজি সরবরাহ বেড়েছে। এতে জ্বালানি তেলের ওপর চাপ কমেছে। এর ফলে এলএনজি আমদানির বিল বকেয়া বেড়েছে। এটি স্বাভাবিক এবং আমরা এটি মোকাবিলায় বিশেষ উদ্যোগ নিচ্ছি।
[১১] পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকারও ৮ জুলাই টিবিএসকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদেরকে পর্যায়ক্রমে বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করছে। এবার একটু বেশি [বকেয়া] জমে গেছে। আমরা আশা করছি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্রুত ডলার সরবরাহ শুরু করবে এবং সমস্যার সমাধান হবে।
[১২] তিনি আরও বলেন, উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। এপ্রিল, মে ও জুন মাসে গরমের কারণে গ্যাসের সরবরাহ বেশি ছিল। যার ফলে কার্গো বেড়েছে এবং বকেয়ার পরিমাণ বেড়েছে। আশা করি, জুলাই মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক সময়মতো ডলার সরবরাহ করলে আমাদের এসব বকেয়া ধীরে ধীরে পরিশোধ করতে পারব।
[১৩] জ্বালানি তেল ও এলএনজির মতো প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির জন্য সোনালী ব্যাংককে ডলার দেওয়ার কথা ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। তবে মে মাসের মাঝামাঝি থেকে এ খাতে ডলার সরবরাহ বন্ধ রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
[১৪] সরকারি সংস্থার আমদানির বেশিরভাগ হয় সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকটির একজন কর্মকর্তা বলেন, আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক চাহিদা অনুযায়ী ডলার সরবরাহ করছে না আগে থেকেই।
[১৫] গত ফেব্রুয়ারি থেকে সরবরাহের মাত্রা আরও বেশি কমানো হয়েছে। মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে ডলার সরবরাহ কার্যত বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে সোনালী ব্যাংক বিদেশি বিভিন্ন ব্যাংকের জরিমানার মুখে পড়ছে।
[১৬] আইএমএফ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) থেকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিচ্ছে বাংলাদেশ। বেশকিছু শর্ত বাস্তবায়ন সাপেক্ষে সাত কিস্তিতে এ ঋণ ছাড় করবে আইএমএফ। প্রতি কিস্তি ছাড়ের আগে শর্তগুলোর বাস্তবায়ন অগ্রগতি দেখে নেয় আইএমএফ। এজন্য গত এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে আইএমএফের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করে।
[১৭] আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী গত জুন শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০.১৯ বিলিয়ন ডলার রাখার কথা ছিল। কিন্তু এ লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে না বলে জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর আইএমএফ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ১৪.৭৫ বিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করে দেয়।
[১৮] আইএমএফের বেঁধে দেওয়া এ শর্ত পূরণে বাংলাদেশ ব্যাংক সব ধরনের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় কমিয়ে এনেছে। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংক সরবরাহে লাগাম টেনে ধরে রেখেছে।
[১৯] জানা গেছে, জ্বালানি আমদানির দায় পরিশোধে প্রতিদিন বাংলাদেশ ব্যাকের ২৫ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার কথা। কিন্তু তার বদলে সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার সংগ্রহ করে দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু এ ব্যাংকগুলোর নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আছে, তা থেকে জ্বালানি আমদানির পুরো দায় মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বকেয়া বেড়ে যাচ্ছে।
[২০] বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৪৮.৮০ লাখ মেট্রিক টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল এবং ১৩.১৪ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করেছে।