
বিতরণ দেখালেও কৃষকের হাতে যায়নি ভর্তুকির

খুলনা প্রতিনিধি : [১] খুলনার কয়রা ও পাইকগাছায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে স্থানীয় কৃষি অফিসের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে ৯ কৃষকের মধ্যে কৃষিযন্ত্র বিতরণ দেখানো হয়েছে। তবে যেসব উপকারভোগীর নাম তালিকায় রয়েছে, তাদের কারও কাছে এসব যন্ত্র পৌঁছায়নি। [২] উপকারভোগীদের বেশির ভাগ প্রকৃত কৃষকও নন। যন্ত্র বিতরণের জন্য সরকারের দেওয়া উন্নয়ন সহায়তার (ভর্তুকি) এ টাকা আত্মসাতে জনপ্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অপকৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
[৩] কয়রা ও পাইকগাছায় যন্ত্র বিতরণের উপকারভোগীদের তালিকা ধরে সরেজমিন ও নানা মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে জানা গেছে, গত অর্থবছরে দুই উপজেলায় ৯ জন উপকারভোগীর মধ্যে প্রতিটি ৩০ লাখ করে ২ কোটি ৭০ লাখ টাকার ‘কম্বাইন হার্ভেস্টার’ বিতরণ দেখানো হয়েছে। তালিকায় কয়রার দু’জন ও পাইকগাছার সাতজন আছেন। কয়রা উপকূলীয় হওয়ায় ৭০ শতাংশ এবং পাইকগাছায় ৫০ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। কয়রার কৃষকরা প্রতিটি ৯ লাখ এবং পাইকগাছায় ১৫ লাখ টাকায় এটি পাওয়ার কথা। [৪] কয়রায় কম্বাইন হার্ভেস্টার যন্ত্র দেওয়া হয়েছে মেঘারাইট গ্রামের আবুল কালাম মিস্ত্রির ছেলে হাফিজুল ইসলাম ও মৃত তসমান মিস্ত্রির ছেলে এনামুল হক মিস্ত্রিকে। দু’জন একই পরিবারের সদস্য। তাদের কোনো কৃষিজমি নেই। [৫] হাফিজুল ডিশ লাইনের ব্যবসা করেন। তার চাচা এনামুল দীর্ঘদিন অসুস্থ। তাদের বাড়ি গিয়ে যন্ত্র পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে হাফিজুল ইসলামের ভাষ্য, সাবেক সংসদ সদস্য আকতারুজ্জামান বাবুর সুপারিশে যন্ত্রের তালিকায় তাদের নাম দেওয়া হয়েছিল। যন্ত্রের ব্যাপারে তারা কিছুই বলতে পারবেন না। [৬] উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, সাবেক সংসদ সদস্যের ডিও লেটার অনুযায়ী দু’জন উপকারভোগী নির্বাচন করা হয়েছিল। ডিও লেটার অফিসে সংরক্ষিত আছে। যন্ত্র বিতরণ সম্পর্কে তিনি কিছু বলতে পারবেন না। উপকারভোগী নির্বাচনে ডিও লেটার দেওয়ার বিষয়ে জানতে সাবেক সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামান বাবুর মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
[৭] জানা গেছে, ভর্তুকি দামে যন্ত্র কেনার জন্য কৃষকদের আবেদনের পর খসড়া তালিকা প্রস্তুত করে উপজেলা বাছাই কমিটি। এতে থাকেন ইউএনও, কৃষি কর্মকর্তা, ইউপি চেয়ারম্যান ও অন্য সদস্যরা। চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুতের পর উপকারভোগীর প্রত্যয়নপত্র দেন কৃষি কর্মকর্তা। ভর্তুকি বাদে বাকি টাকা দিয়ে প্রত্যয়নপত্র দেখিয়ে কৃষক ডিলারের কাছ থেকে যন্ত্রটি সংগ্রহ করেন।
[৮] পাইকগাছা কৃষি অফিসের তালিকা অনুযায়ী, ভর্তুকি মূল্যে যন্ত্র পাওয়া কৃষকরা হলেন সোলাদানা ইউনিয়নের নারকেলপোতা গ্রামের কামরুল ইসলাম, গড়ইখালী ইউনিয়নের মুজাহিদুল ইসলাম, কপিলমুনি ইউনিয়নের কাজিমুসা গ্রামের মিজানুর খাঁ, হরিঢালী ইউনিয়নের ইসমাইল হোসেন, গড়ইখালী ইউনিয়নের আমিরপুর গ্রামের উত্তম মণ্ডল, কানাখালী গ্রামের প্রদীপ সানা ও হরিঢালী ইউনিয়নের সোনাতনকাটি গ্রামের এসকেনদার শেখ। তাদের বাড়িতেও হারভেস্টার পাওয়া যায়নি।
[৯] অনুসন্ধানে জানা গেছে, গড়ইখালী গ্রামের উপকারভোগী মুজাহিদুল ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। চাষাবাদের মতো কোনো জমি তাঁর নেই। ১৫ লাখ টাকা দিয়ে হার্ভেস্টার যন্ত্র কেনার সক্ষমতাও নেই তাঁর। তিনি বলেন, ‘জমি নেই, মেশিন কিনে কী করব।
[১০] কানাখালী গ্রামের প্রদীপ সানা পেশায় শ্রমজীবী। তার নামে একটি হার্ভেস্টার যন্ত্র বিতরণ দেখানো হয়েছে। জানতে চাইলে প্রথমে তিনি কম্বাইন হার্ভেস্টার যন্ত্র কী, তা বুঝতে পারেননি। পরে বলেন, একটা যন্ত্র নিয়েছিলাম। তা এখন অফিসেই আছে। আরেক উপকারভোগী হরিঢালী গ্রামের
[১১] ইসমাইল হোসেনের বাড়িতে গেলে তিনি বলেন, ১৫ লাখ ৮৫ হাজার টাকা জমা দিয়ে কৃষি অফিস থেকে যন্ত্রটি নিয়েছিলাম। এখন তা আমার কাছে নেই। কোথায় আছে জানতে চাইলে তিনি স্পষ্টভাবে কিছু বলতে পারেননি।
[১২] খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপকারভোগীদের তালিকায় থাকা নামের বেশির ভাগই প্রকৃত কৃষক নন। কেউ ব্যবসায়ী, কেউ রাজনৈতিক কর্মী। আছেন শ্রমজীবীও। তবুও তাদের নামে কৃষিযন্ত্র বরাদ্দ দেখানো হয়েছে। অথচ কারও কাছে এ যন্ত্র পৌঁছায়নি। এসব কাগজে বিতরণ দেখিয়ে ভর্তুকির টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
[১৩] এ বিষয়ে পাইকগাছার কৃষি কর্মকর্তা অসীম কুমার দাশের ভাষ্য, তালিকায় থাকা উপকারভোগীদের মধ্যে কয়েকজন হার্ভেস্টার যন্ত্র নিয়েছেন। অনেকেই নেননি। তবে যেসব উপকারভোগী যন্ত্র নিয়েছেন বলে তিনি দাবি করেছেন, তাদের কারও কাছে যন্ত্র পাওয়া যায়নি। আর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহেরা নাজনীন বলেন, কৃষি অফিস থেকে কম্বাইন হার্ভেস্টার যন্ত্র বিতরণের তালিকা দেখেছেন তিনি। তবে বিতরণ হয়েছে কিনা, তা খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।
[১৪] সরকারের উন্নয়ন সহায়তার টাকা এভাবে পরিকল্পিতভাবে নয়ছয় করা বড় অপরাধ উল্লেখ করে কয়রা উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ আলম বলেন, জড়িতদের বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। ¿
