ইউরোপ-আমেরিকা যাচ্ছে নোয়াখালীর ছানা মিষ্টি
নোয়াখালী প্রতিনিধি : [১] ভোজনরসিক বাঙালির কাছে মিষ্টি যেন এক অমৃত স্বাদের খাবারের নাম। মিষ্টির নাম শুনলেই জিভে জল আসে না এমন মানুষ মেলা ভার। আর সেটি যদি হয় সুস্বাদু তাহলে তো কথাই নেই। এমনই এক মিষ্টির নাম নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীর দেওটির ছানা মিষ্টি। শত বছরের ঐতিহ্যের এ ছানা মিষ্টি এবার যাচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকায়। [২] কেবল ইউরোপ, আমেরিকা নয় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেও ব্যাপক জনপ্রিয় দেওটির এ সুস্বাদু ছানা মিষ্টি। উৎসব ছাড়াই এ মিষ্টি খেতে সারাবছর ভিড় লেগে থাকে। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ বিখ্যাত এ মিষ্টির স্বাদ নিতে ভিড় করেন দোকানে। স্থানীয় ইউনিয়নের নামানুসারে এ মিষ্টি দেওটির মিষ্টি নামেই প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। দিন দিন বাড়ছে মুখরোচক দেওটির ছানা মিষ্টির চাহিদা। [৩] সরেজমিনে সোনাইমুড়ী উপজেলার দেওটি ইউনিয়নের দেওটি বাজারের বিভিন্ন মিষ্টির দোকানে গিয়ে দেখা যায়, দূরদূরান্ত থেকে বিভিন্ন পরিবহনে মুখরোচক দেওটির মিষ্টি খেতে আসছেন মানুষজন। অনেক ক্রেতারা মিষ্টি কেনার জন্য ভিড় করেছেন মিষ্টির দোকানে । অন্যদিকে ব্যস্ত সময় পার করছেন কারিগররা। [৪] দোকানিরা বিভিন্ন এলাকা থেকে খাঁটি গরুর দুধ সংগ্রহ করে তা পাতিলে গরম করেন। তারপর টক ব্যবহার করে দুধ থেকে ছানা আলাদা করেন। সম্পূর্ণ পানি মুক্ত করার পর ছানাকে আঠালো করতে এর সাথে অল্প কিছু ময়দা মিশ্রণ করে খামির করা হয়। এরপর সেই খামিরকে গোল করে ছোট ছোট মিষ্টির আকৃতি দেওয়া হয়। এই কাঁচা মিষ্টিকে চিনি মিশ্রিত পানির মধ্যে ডুবিয়ে গরম করে বানানো হয় দেওটির সুস্বাদু ছানার মিষ্টি।
[৫] জানা যায়, প্রায় একশ বছর পূর্বে নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ী উপজেলার দেওটি ইউনিয়নের বটখিল গ্রামের করুণা মন্দার বাড়ির করুণা বাবু মজুমদারের হাতেই এই মিষ্টির যাত্রা শুরু হয়। পাশাপাশি সময়ে শুক দেবনাথ নামের আরেকজনও এই বাজারে মিষ্টি বানানো শুরু করেন। প্রথম দিকে করুণা বাবু মজুমদার বাড়িতে বসেই মিষ্টি তৈরি করে বিক্রি করতেন। চাহিদা বাড়ার পর দেওটি বাজারে মিষ্টির দোকান খুলে বসেন তিনি। দোকানটির নাম করুণা মজুমদার মিষ্টি ভাণ্ডার।
[৬] ১৪ বছর আগে করুণা বাবু মারা যান। এরপর মারা যায় তার বড় ছেলে বাবুল চন্দ্র মজুমদার। এখন তাদের দোকান যৌথভাবে পরিচালনা করছেন করুনা বাবুর অন্য চার ছেলে হরিপদ চন্দ্র মজুমদার, দীপক চন্দ্র মজুমদার, পরিমল চন্দ্র মজুমদার ও লিটন চন্দ্র মজুমদার। বর্তমানে বিসমিল্লাহ ও মুসলিম সুইটস নামের দুইটি মিষ্টির দোকানসহ মোট চারটি দোকান রয়েছে।
[৭] আমেরিকা প্রবাসী আবু নাছের বলেন, ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে এসেছি। পরিবারের সদস্য ও প্রবাসী বন্ধুরা দেওটির ছানা মিষ্টি পছন্দ করে। তাই আমরা সব সময় এই মিষ্টি নিয়ে যাই। আমেরিকা ছাড়াও ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে এই মিষ্টি যায়। এই মিষ্টি খেয়ে তার দেশি ও বিদেশি বন্ধুরা অনেক প্রশংসা করেন। আমার মতো অনেক প্রবাসী দেশ থেকে যাওয়ার সময় ছানা মিষ্টি কিনে নিয়ে যায়।
[৮] মুসলিম মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের স্বত্বাধিকারী শহীদ কাউসার বলেন, করুণা মজুমদার মিষ্টি ভাণ্ডার ছাড়াও দেওটি বাজারে আরও ৩টি মিষ্টির দোকানে মিষ্টি বেচাকেনা হয়। তারমধ্যে পুরোনো একটি হলো নারায়ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। এটিও করুণা মজুমদার মিষ্টি ভাণ্ডারের প্রায় সমসাময়িক সময়ে গড়ে ওঠে। শুক দেবনাথ ছিলেন এ দোকানের কর্ণধার। শুক দেবনাথ মারা যাওয়ার পর বর্তমানে তার ছেলে স্বপন দেবনাথ চালাচ্ছেন এ দোকানটি। বিভিন্ন সময়ে করুণা বাবুর দোকানের কারিগরদের কয়েকজন বের হয়ে যান। তাদের হাত ধরেই ৬-৭ বছর পূর্বে গড়ে ওঠে মুসলিম মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। এটিও এখন এই বাজারে অন্যতম জনপ্রিয় একটি মিষ্টির দোকান। একইভাবে তিন বছর আগে গড়ে উঠে ।
[৯] বিসমিল্লাহ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের কর্ণধার সাইফুল ইসলামও একসময় করুণা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে কারিগর হিসেবে কাজ করতেন। বিসমিল্লাহ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের স্বত্বাধিকারী সাইফুল ইসলাম বলেন, এক দোকানের মিষ্টির সঙ্গে আরেক দোকানের মিষ্টির স্বাদে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। যে কারণে ৪টি দোকানেই এখন সমানতালে বিক্রি হয় দেওটির ছানার মিষ্টি। বিভিন্ন উৎসবের সময় ছানার মিষ্টির জন্য এখানকার দোকানগুলোতে উপচে পড়া ভিড় লেগে থাকে।
[১০] করুণা চন্দ্রের নাতি কাঞ্চন মজুমদার বলেন, ঈদসহ বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে দেওটি বাজারে দৈনিক আটশো কেজির মতো মিষ্টি বিক্রি হয়। নোয়াখালীর বিভিন্ন উপজেলা ছাড়াও পাশের জেলাগুলো থেকে এখানে মিষ্টি খেতে দল বেঁধে আসেন তরুণ-যুবকরা। আত্মীয়স্বজনদের হাত ধরে ইউরোপ, আমেরিকাসহ মধ্যপ্রাচ্যে থাকা বাংলাদেশির কাছে চলে যায় এখানকার মিষ্টি। বর্তমানে এখানকার প্রতি কেজি মিষ্টি বিক্রি হয় ২৪০ টাকা করে। মূলত আমার দাদার হাত ধরেই এখানকার মিষ্টির সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এখন আরও অনেকেই মিষ্টি বানাচ্ছেন। দুধের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের মিষ্টি তৈরিতে ব্যয় বেড়েছে। যে কারণে মিষ্টি বিক্রি করে আমাদের এখন তেমন লাভ হচ্ছে না।
[১১] শাহ আলম নামের এক লন্ডন প্রবাসী বলেন, এখানকার মিষ্টির সুনাম শুনেছি। আমার বিয়েতেও এই মিষ্টি খেয়েছি। মাইজদী থেকে আমার স্ত্রী সহ এই মিষ্টি খেতে আসছি। খেয়ে ভালোই লেগেছে। দেখতে যেমন সুন্দর খেতেও তেমন সুস্বাদু। দামও তুলনামূলক ভাবে অনেক কম।
[১২] দেওটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল আমিন শাকিল ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনেক দূরদূরান্ত থেকে এই মিষ্টি খাওয়ার জন্য মানুষ এখানে আসেন। এই মিষ্টির সঙ্গে এখানকার প্রায় শত বছরের ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে। এখানকার মিষ্টি মানুষ ইউরোপ আমেরিকায় থাকা তাদের আত্মীয়-স্বজনদের কাছেও পাঠান। ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমরা মূল্য সীমিত রেখেছি। এতে ব্যবসায়ীদের কষ্ট হচ্ছে তবে সুনাম অক্ষুণ্ন রাখতে তারাও বদ্ধ পরিকর।