
প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর : বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কে নতুন ভোর

কামাল উদ্দিন মজুমদার
তিন দিনের দ্বিপক্ষীয় সফর শেষে বেইজিং থেকে ঢাকায় ফিরেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৮ থেকে ১০ জুলাই পর্যন্ত বেইজিংয়ে অবস্থানকালে প্রধানমন্ত্রী চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন ও চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের সঙ্গে প্রতিনিধি পর্যায়ের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকসহ বিভিন্ন কর্মসূচি সম্পন্ন করেন। এই দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় প্রধানত ব্যবসা, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয় ছিল। জুন মাসে ভারতে দুটি ফলপ্রসূ সফরের পর শেখ হাসিনার চীন সফরকে ভারসাম্যমূলক কূটনীতি হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। বাংলাদেশ গত কয়েক দশক ধরে চীনকে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সহযোগী ও ভারতকে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক মিত্র হিসেবে দেখেছে। বাংলাদেশ জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে এই দুই প্রভাবশালী দেশের মধ্যে সূক্ষ্ম কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে। ভারত ও চীনে ধারাবাহিক রাষ্ট্রীয় সফরের মাধ্যমে এটিকে আরও সুসংহত করা হবে। ভারত ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এখন অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়’ বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্র নীতির মূলমন্ত্র থেকে বিচ্যুত হবে না। এই বার্তা সম্ভবত প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পরপরই চীন সফরের মাধ্যমে উভয় দেশের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করে বলেন, ভারত ও চীনের বৈরিতা তাদের নিজস্ব বিষয় ও বাংলাদেশ নিজেদের স্বার্থেই উভয় দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখবে। এবারের প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর ভূ-রাজনৈতিক কারণে ও অর্থনৈতিক সংকটের বাস্তবতার কারণে বাংলাদেশের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। গত এক দশকে ব্যাপক বিনিয়োগের মাধ্যমে চীন বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী হয়ে উঠেছে। পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু টানেলের মতো দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে চীনা অর্থায়ন ও প্রযুক্তি অবদান রেখেছে। বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে এই সম্পর্ক আরও দৃঢ় হলে দেশের উন্নয়নের গতি বাড়বে। ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে চীনের বিনিয়োগ প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার।
প্রধানমন্ত্রীর সফরে চীনের সঙ্গে ২১টি সমঝোতা স্মারক ও ৭টি ঘোষণা স্বাক্ষর হয়েছে। যার মধ্যে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি ও একটি দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ প্রচার চুক্তির জন্য একটি সম্ভাব্যতা স্টাডি সম্পন্ন করা রয়েছে। চীনের নতুন বিনিয়োগ ঘোষণা বাংলাদেশের জন্য খুবই ইতিবাচক। বাংলাদেশের বাণিজ্যিক দিক থেকেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে চীন বাংলাদেশের একক বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চীনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলারের। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ চীনে ৬৭৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে ও চীন থেকে ২২.৯০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। প্রধানমন্ত্রী বেইজিংয়ে চীনা ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগের এখনই উপযুক্ত সময়। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুযোগ ও এ বিষয়ে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের কথাও তুলে ধরেন। চীনা বিনিয়োগ যদি তার বিনিয়োগ বাড়ায়, তা হবে দেশের অর্থনীতির জন্য খুবই ইতিবাচক। একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিতে, চীন ও বাংলাদেশ তাদের সম্পর্ককে ‘সহযোগিতার কৌশলগত অংশীদারিত্ব’ থেকে ‘বিস্তৃত কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্ব’-এ উন্নীত করেছে। চায়না ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের একটি নিবন্ধ অনুসারে, ‘কৌশলগত অংশীদারিত্ব’ শব্দটির সঙ্গে ‘ব্যাপক’ শব্দটি যোগ করার অর্থ হলো যে অংশীদারিত্বটি রাজনীতি, অর্থনীতি, বাণিজ্য, নিরাপত্তা, মানবিকতা, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিষয় এটি ইঙ্গিত দেয় যে উভয় পক্ষ তাদের সম্পর্ককে উচ্চ স্তরে স্বীকৃতি দেয়, অনুসরণ করে। ব্যাপক অংশীদারিত্ব শব্দটি সাধারণত বোঝায় যে সম্পর্কগুলো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, মানবতাবাদী, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিষয় সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার সঙ্গে পরিপক্কতা ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের তুলনামূলকভাবে উচ্চ স্তরে পৌঁছেছে। প্রধানমন্ত্রী এমন এক সময়ে চীন সফর করেছেন যখন দেশের অর্থনীতি কঠিন সময় পার করছে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বৈদেশিক বাণিজ্য বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক সহায়তা ও বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। এ বছর প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে এসব বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে। চীন বাংলাদেশকে অনুদান ও তিন ধরনের ঋণের আকারে অর্থনৈতিক সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে: সুদমুক্ত ঋণ, রেয়াতি ঋণ ও বাণিজ্যিক ঋণ।
চীন বাংলাদেশকে এক বিলিয়ন ইউয়ান (প্রায় ১৪০ মিলিয়ন ডলার) অর্থনৈতিক সহায়তার প্রস্তাবও দিয়েছে। বেইজিং বলেছে যে তারা ঢাকার সঙ্গে তার সম্পর্ককে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয় ও বাংলাদেশকে তার উন্নয়নের যাত্রা অব্যাহত সমর্থনের আশ্বাস দিয়েছে। শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে শি বলেন, চীন বাংলাদেশে আরও বিনিয়োগ করতে চায় ও আন্তর্জাতিক মঞ্চে এর সঙ্গে কাজ করতে চায়। বাংলাদেশ ও চীন উন্নয়ন পরিকল্পনা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন নীতিতে অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি বাড়াতে একত্রে পরিকল্পনা, একসঙ্গে নির্মাণ ও একসঙ্গে লাভবান হওয়ার নীতির অধীনে উচ্চ-মানের বেল্ট অ্যান্ড রোড সহযোগিতাকে আরও গভীর করতে সম্মত হয়েছে। উভয় পক্ষ বিদ্যমান সহযোগিতা প্রকল্পগুলোকে ত্বরান্বিত করবে, সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলিকে প্রসারিত করবে ও বাস্তব সহযোগিতায় আরও ফলপ্রসূ ফলাফলের দিকে কাজ করবে। ২৭-দফা যৌথভাবে এই অঞ্চলকে সুষম ও সাসটেইনেবল উন্নয়ন অর্জনে সহায়তা করার জন্য বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-এর কাঠামোর অধীনে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় সমন্বিত উন্নয়ন উদ্যোগ বাস্তবায়নে চীনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ পক্ষের পরিকল্পনা সমর্থন করা হয়েছে। বেইজিংয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি সফর শেষে জারি করা বিবৃতি। রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে চীনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীনা পক্ষ বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য বাংলাদেশের কয়েক বছর ধরে করা প্রচেষ্টার প্রশংসা করেছে, বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে, দেশগুলোর মধ্যে বিদ্যমান প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা অনুসরণ করে পারস্পরিকভাবে গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে পেতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছে। প্রয়োজনে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে এমনকি আরাকান সেনাবাহিনীর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আশা করা যায় চীন এই বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে নেবে। আগামী বছর চীন ও বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করবে। উভয় দেশ উচ্চ-পর্যায়ের মিথস্ক্রিয়া গতি বজায় রাখবে, কৌশলগত যোগাযোগ বাড়াবে, বহুপাক্ষিক অনুষ্ঠানে সফর, চিঠি বিনিময় ও বৈঠকের মাধ্যমে কৌশলগত পারস্পরিক বিশ্বাসকে গভীর করবে বলে আশা করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফর হবে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বন্ধুত্বের মডেল হিসেবে গড়ে তোলার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। লেখক : নিরাপত্তা ও কৌশলগত বিষয়ক বিশ্লেষক। অনুবাদ : জান্নাতুল ফেরদৌস। সূত্র : ডেইলি অবজার্ভার
