
লোডশেডিং কমাতে বিদ্যুতের যথার্থ ব্যবহার করতে হবে
শেখ সায়মন হিমেল পারভেজ : স্মার্ট বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমি আমার কিছু বিষয় সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কিছু জানাতে চাই, শুধু আমার ব্যক্তিগত মতামত থেকে নয়, আমার গ্রামবাসীর গুরুতর সংকট সম্পর্কে আমার পর্যবেক্ষণ থেকেও। আমি এই ঈদের ছুটিতে ছিনিয়ে নেওয়া একটি সাম্প্রতিক স্মৃতি শেয়ার করেছি। ঈদের ১ দিন আগে আমার গ্রামটি দিনে ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা বিদ্যুতের সুবিধা থেকে সম্পূর্ণভাবে বঞ্চিত ছিল। আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম কারণ আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের হলটিতে অবিরাম বিদ্যুৎ পরিষেবা ব্যবহার করতাম, যা একটি শহরের কাছে অবস্থিত ছিল। কিন্তু এটা অস্বীকার করা সম্ভব নয় যে সমস্ত গ্রামবাসী বিদ্যুৎ পরিষেবায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে যা ১০ বছরের আগে অবিশ্বাস্য ছিল। তাই এই মহৎ কর্মকাণ্ডের জন্য আমি সরকারকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাই। আমাদের ঘরে বিদ্যুৎ ব্যবহারে অসচেতনতার কারণে আমাদের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করা কঠিন। সাধারণত দেখা যায় আমাদের দেশের দেশবাসী বিদ্যুৎ ব্যবহারে এতটাই অসচেতন। সুইচ অফ করার সময় তারা খুব অলস বোধ করে। তারা লাইট, ফ্যান বা মোটর বন্ধ না করেই বাইরে যায়। এগুলো কেবল ধর্মীয় ধারণা থেকে নয়, ন্যূনতম দায়িত্ব থেকেও চূড়ান্তভাবে অবৈধ। ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাদের শয়তানের বন্ধু বলে সম্বোধন করার মাধ্যমে অপচয় করার প্রবণতা সম্পূর্ণরূপে নিঃসৃত হয়। অ্যারিস্টটলের মতে, একজন নাগরিক এমন একজন ব্যক্তি যিনি শাসন করার ও শাসিত হওয়ার (বা শাসিত হলেও শাসিত নয়) গুণাবলীর অধিকারী হন। এর মানে হলো যে আমরা সহজেই অনাগরিকদের শনাক্ত করতে পারি: এরা এমন ব্যক্তি যাদের গুণাবলী নেই (বা থাকতে সক্ষম নয়)। এই ধারণা থেকে, আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে ভালো নাগরিক হিসেবে আমাদের অবশ্যই বিদ্যুতের সঠিক ব্যবহার করতে হবে ও সুইচ বন্ধ করার অলসতার প্রবণতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে।
এখন আমরা সেই বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করি। দ্য ডেইলি স্টারস রিপোর্ট অনুযায়ী, আরইবির কাছে চাহিদার তুলনায় ৩০ শতাংশ কম বিদ্যুৎ ছিল। যার ফলে দুই মাসে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে প্রতিদিন ৮-১০ ঘণ্টা লোডশেডিং হয়েছে। বাংলাদেশে দৈনিক বিদ্যুতের চাহিদা ১৩,০০০ মেগাওয়াট (মেগাওয়াট) থেকে সর্বোচ্চ ১৭,০০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত। সাধারণত দেশে প্রয়োজনের ভিত্তিতে ১৩,০০০ মেগাওয়াট থেকে ১৫,০০০ মেগাওয়াটের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। বর্তমানে দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী, ২৭,৫১৫ মেগাওয়াট। পিডিবি ডেটা দেশের প্রায় ৫০ শতাংশ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এখন অলস বসে আছে। গ্যাস-ভিত্তিক প্ল্যান্টগুলো প্রায় ৫,৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে, সর্বোচ্চ ১১,৫০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার বিপরীতে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দ্বিতীয় সর্বোচ্চ, ৪,৩০০ মেগাওয়াট উৎপাদন করছে ও তরল জ্বালানি-ভিত্তিক প্ল্যান্টগুলো উৎপাদন করছে ২,৯০০ মেগাওয়াট। বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্য অনুযায়ী, দেশের বিদ্যুৎ খাতের মোট উৎপাদন ক্ষমতা চলতি বছরের শেষ নাগাদ ৩১ হাজার মেগাওয়াটে দাঁড়াবে। ২০২৩ সালে দেশে সর্বোচ্চ গড় দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল সেপ্টেম্বরে ১৩,২০৮ মেগাওয়াট। গড় উৎপাদন জানুয়ারিতে সর্বনিম্ন ৯,৬০০ মেগাওয়াটে নেমে আসে। ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ঘটলেও এ বছর বিদ্যুতের সর্বোচ্চ গড় উৎপাদন ১৫ হাজার মেগাওয়াটেই থাকবে। তবে বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এ বছর বিদ্যুতের সর্বোচ্চ উৎপাদন ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট।
দৈনিক বণিক বার্তার সূত্রে জানা গেছে বিপিডিবির তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ২৫ হাজার ৯৫১ মেগাওয়াট। ২০২৪ সালে, সর্বমোট কমপক্ষে ৫,৪৮০ মেগাওয়াট সরকারি, বেসরকারি ও যৌথ বিদ্যুৎ কেন্দ্র যুক্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এর মধ্যে সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ২ হাজার ৭৭৪ মেগাওয়াট, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১ হাজার ৪৯২ মেগাওয়াট ও যৌথ বিদ্যুৎকেন্দ্র (পিপিপি) থেকে ১ হাজার ২৪৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হবে। এই ক্ষমতা যুক্ত হলে দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৩১ হাজার ৪৩১ মেগাওয়াটে পৌঁছাবে। তবে লোডশেডিং বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার অংশ হিসেবে কাজ করে। তাই চিন্তিত হওয়ার দরকার নেই; শুধু সুনাগরিক হওয়ার নির্দেশনা বজায় রাখুন। আমরা সৌর শক্তি বা বায়োএনার্জির মতো বিকল্প উৎস খুঁজতে পারি। উদাহরণস্বরূপ, গ্রামাঞ্চলের লোকেরা তাদের রান্নাঘরের কাজে বায়োগ্যাস ব্যবহার করতে পারে। সাধারণত, রান্নার যন্ত্র ব্যবহার করার সময় আমরা প্রচুর বিদ্যুৎ ব্যবহার করি। বায়োগ্যাস প্রাকৃতিক গ্যাস সংরক্ষণকেও সমর্থন করে ও আমরা জানি যে প্রাকৃতিক গ্যাস বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল। শহরাঞ্চলে তারা অনেক ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে। এই ডিভাইসগুলো এয়ার কন্ডিশনার (এসি) এর মতো মিশ্র পরিমাণ বিদ্যুৎ ক্যাপচার করে। এই প্রবণতা বন উজাড়ের দ্বারা তৈরি হয় কারণ পরিবেশ একটি নির্দিষ্ট শহরের এলাকায় উষ্ণ বাতাস ছড়ায়। এসির ব্যবহার শুধুমাত্র ওভার-রেঞ্জের বিদ্যুৎ ছিনিয়ে নেয় না বরং সিএফসি (ক্লোরোফ্লুরোকার্বন) এর বিপদও তৈরি করে যা ওজোন ঢালকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। আমি আমার বিষয় নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। সৌর শক্তিতে আমরা এটিকে ইলেকট্রনিকভাবে সংরক্ষণ করতে পারি ও যেকোনো জায়গায় এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও আমাদের ইচ্ছা অনুযায়ী ব্যবহার করতে পারি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২১ সালে জনসংখ্যার প্রায় ২.২৫ শতাংশ এসএইচএস (সোলার হোম সিস্টেম) ব্যবহার করেছে। ২০২৩ সালে সংখ্যা কমে ১.৮১ শতাংশ হয়েছে। আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সৌরজগতকে ব্যবহার করতে পারি। শহরের এলাকায় দিনেও ল্যাম্পপোস্ট চালু থাকে ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্মচারীদের দায়িত্বহীনতার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে এতোটাই উদাসীন। এই ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন কর্মচারীকে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে।
আমি আপনাকে আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা থেকে একটি উদাহরণ দিচ্ছি। আমার বড় বোনের বাড়ি উপজেলা শহরে। আমি যখন সকালে হাঁটতে বের হলাম দেখলাম স্ট্রিট ল্যাম্প জ্বলছে। সেই সময়ে আমি কিছু করার সমস্ত ইচ্ছা হারিয়ে ফেলেছিলাম, যদিও রাস্তার বাতি জ্বলছিল। এটি একটি এক্সিওম তত্ত্ব নয়; এটা অন্যদের থেকে আলাদা হবে। কীভাবে আমরা এই সমস্যাটি কাটিয়ে উঠতে পারি, আমাদের এখনই জানতে হবে। তার আগে প্রথম আলোতে একটি সাক্ষাৎকারের কথা না বললেই নয়। প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এম শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ খাতের এই সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় কী? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যাতায়াতের পথ সোজা। স্বাধীনতার পর জ্বালানি খাতকে স্বাবলম্বী করতে পেট্রোবাংলা করা হয়। কিন্তু বিগত সরকার একে নির্ভরশীল করে তুলেছে। জ্বালানি বা বিদ্যুৎ খাত কীভাবে চলবে তা আমলাদের ঠিক করা উচিত নয়। বিইআরসি (বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন) স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কথা বলা উচিত। বিদ্যুৎ বিভাগও শুনুক। কীভাবে দেশের সম্পদ রক্ষা করা যায় ও কীভাবে জনগণের জন্য বিদ্যুৎ সহজলভ্য করা যায় তা ভাবতে হবে। বাইরের কারো পরামর্শে জ্বালানি খাত চলে তাহলে দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। গ্রামীণ শহরে বিদ্যুতের লোডশেডিং মোকাবেলায় শিল্প, রাষ্ট্র, সমাজ ও জনগণকে আরও সাশ্রয়ী হতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিল্পের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। বিকল্প শক্তির উৎসে সৌরশক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সৌরশক্তি বিকল্প শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশ এখনো অপ্রতুল। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত গবেষণার দিকে মনোনিবেশ করা, যেখানে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা অত্যন্ত কাম্য। সরকারের উচিত বিভিন্ন নীতি ও পরিকল্পনার মাধ্যমে গ্রামীণ শহরে বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা, সরবরাহ নিশ্চিত করা। এদেশের প্রতিটি গ্রামীণ জনপদ ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বাদ পেয়েছে।
লেখক : ক্যাম্পাস জার্নালিস্ট, স্টুডেন্ট অব মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। অনুবাদ : জান্নাতুল ফেরদৌস। সূত্র : ডেইলি অবজার্ভার
