
দেশের মূল্যস্ফীতি অথবা মুদ্রাস্ফীতি রোধ সম্ভব কোন পথে?

সুব্রত বিশ্বাস
চলতি অর্থবছরের জন্য যে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হচ্ছে তা আরো কঠোর করা ছাড়া বিকল্প নেই, মুদ্রা বিনিময় হারের অস্থিতিশীলতা, মূল্যস্ফীতির চাপ ও দীর্ঘমেয়াদি খেলাপি ঋণ বিদ্যমান। এমন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে নতুন মুদ্রানীতি কঠোর করা ছাড়া বিকল্প নেই, অর্থনীতির বৈদেশিক খাতের সব সূচকই অবনতি এই প্রশ্ন দুটি সামনে নিয়ে আসে, বৈদেশিক মুদ্রা বিশেষ করে ডলারের দাম কি আরো বাড়তে পারে, সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে ও মূল্যস্ফীতি কমাতে আসন্ন মুদ্রানীতি আরো কঠোর হবে কিনা কঠোর হবে কিনা? মুদ্রানীতির মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস করার জন্য সাধারণত এই ধরনের কাজ জড়িত থাকে কমন পলিসি সুদের হার বৃদ্ধি, কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলি ঋণ গ্রহণকে আরও ব্যয়বহুল করতে সুদের হার বাড়াতে পারে, যার ফলে ভোক্তাদের ব্যয় এবং বিনিয়োগ হ্রাস পায়, যা মুদ্রাস্ফীতি কমাতে সাহায্য করতে পারে।
অর্থ সরবরাহ হ্রাস করা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলি সরকারী সিকিউরিটিজ বিক্রি করে বা ব্যাংকগুলির জন্য রিজার্ভের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি করে, অর্থনীতিতে সঞ্চালিত অর্থের পরিমাণ হ্রাস করে মুদ্রানীতি কঠোর করতে পারে। ফরোয়ার্ড গাইডেন্স, সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কগুলি প্রত্যাশাগুলি পরিচালনা করতে এবং অর্থনৈতিক আচরণকে প্রভাবিত করার জন্য ভবিষ্যতের আর্থিক নীতির ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে জনসাধারণ এবং আর্থিক বাজারের কাছে তাদের উদ্দেশ্যগুলি স্পষ্টভাবে জানাতে পারে। বিনিময় হারের হস্তক্ষেপ, কিছু ক্ষেত্রে, কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলি বিনিময় হার স্থিতিশীল করার জন্য মুদ্রা বাজারে হস্তক্ষেপ করতে পারে, যা আমদানি মূল্যের মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতিকে পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করতে পারে। মনিটরিং এবং ডাটা অ্যানালাইসিস, ক্রমাগত অর্থনৈতিক তথ্য যেমন মুদ্রাস্ফীতির প্রবণতা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, এবং কর্মসংস্থানের পরিসংখ্যান, প্রয়োজন অনুযায়ী আর্থিক নীতি সামঞ্জস্য করার জন্য নিরীক্ষণ করা।
ব্যবস্থাগুলির কার্যকারিতা নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক অবস্থা এবং মুদ্রাস্ফীতির অন্তর্নিহিত কারণগুলির উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে। এটির জন্য প্রায়শই একটি ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতির এবং স্বল্প-মেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী উভয় অর্থনৈতিক প্রভাবের সতর্ক বিবেচনার প্রয়োজন হয়। অর্থনৈতিক বিশ্লেষক এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন অস্থিরতার মুখোমুখি অর্থনীতি, বিদায়ী অর্থবছরে দেশের বৈদেশিক খাতে সবচেয়ে বেশি অস্থিরতার মুখোমুখি হয়েছে। বিদায়ী অর্থবছরে সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হয়েছিল। এতে কঠোর করা হয়েছিল মুদ্রানীতি। কিন্তু কঠোর মুদ্রানীতি অনুসরণের পরও বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে।মূল্যস্ফীতি বাড়ার অন্যতম চারটি প্রধান কারণ.. ডলারের বিপরীতে টাকার মান অবমূল্যায়ন করা, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করা এবং একই সাথে খাদ্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়া।আর এসব কারণে কঠোর মুদ্রানীতির পরও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।
বিশ্বের প্রধান কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলির নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রথা পৃথিবীর সব দেশেই চালু আছে। অনেক দেশ এটা করে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।তাহলে বাংলাদেশ কেন ব্যর্থ হচ্ছে? অর্থনীতিকে আক্রান্ত এর ক্ষত অর্থনীতিতে এখনো চলমান বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবে ঘাটতি কমে এখন আবার উদ্বৃত্ত হয়েছে। সূত্র মতে, রফতানি আয়ের বাড়তি তথ্য বাদ দেয়ার ফলে চলতি হিসাব আবার ঘাটতিতে চলে গেছে। একই সাথে আর্থিক হিসাব ও সার্বিক বৈদেশিক মুদ্রার হিসাবে ঘাটতি আরো বেড়ে গেছে। বাণিজ্য ঘাটতি কমেছে। বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতিপত্রের ঘাটতিও কমেছে। তবে আর্থিক হিসাব ও সার্বিক বৈদেশিক মুদ্রার হিসাবে ঘাটতি থাকায় ডলারের বিনিময় হারে চাপ অব্যাহত রয়েছে। এ কারণে টাকার মান কমাতে হচ্ছে, যা মূল্যস্ফীতিতে চাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। ডলার সঙ্কটের কারণে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করায় এ খাতের শিল্প উৎপাদন কমেছে। বিদায়ী অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে এ খাতে প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। কৃষিতেও প্রবৃদ্ধি হয়েছে ধীর।
বাজারে বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে। এতে রিজার্ভ কমেছে। বাজারে ডলারের ওপর চাপও কিছুটা কমেছে। ডলারের বিনিময় হারে যে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। এই পদ্ধতি দেশীয় মুদ্রার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার সমন্বয়ের একটি পদ্ধতি। এই পদ্ধতি দেশীয় মুদ্রার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার সমন্বয়ের একটি পদ্ধতি। এতা অব্যাহত রাখবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে প্রয়োজন অনুসারে এর দামে সমন্বয় সাধন করবে। অর্থাৎ প্রয়োজন হলে ডলারের দাম আরো বাড়াবে।আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে চলতি অর্থবছরের প্রথম মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহারের করিডর প্রথা চালু, সুদহারের সীমা প্রত্যাহার, ডলারের একক দাম, রিজার্ভের প্রকৃত হিসাবায়নসহ নানা উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এবার মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে। সরকারি ব্যয় হ্রাস ২. করের পরিমাণ বৃদ্ধি ৩. সরকারি ঋণ ৪. সঞ্চয় বৃদ্ধি (গ) প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণঃ- আর্থিক ও রাজস্ব পদ্ধতি ছাড়াও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকার কিছু প্রত্যক্ষ ব্যবস্থা(উরৎবপঃ ঈড়হঃৎড়ষ) নিতে পারে। খুবই সাধারণ ধারণা হলো, স্বল্প পরিমাণ পণ্য ও সেবা ক্রয়ে যখন অনেক অর্থ ব্যয় করা হয়, তখনই মূল্যস্ফীতির সমস্যা তৈরি হয়। বিষয়টি যতটা সরল হিসেবে দেখা হয় আসলে তা নয়। অর্থের জোগান বাড়লেও অর্থের হাতবদলের হার কমে গিয়েও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অপরিবর্তিত থাকতে পারে। তখন অর্থের সরবরাহজনিত মূল্যস্ফীতি নাও ঘটতে পারে। সামগ্রিকভাবে যদি মানুষের আয় না বাড়ে তাহলে পণ্য ও সেবার চাহিদাও বাড়বে না। বাজারে সরবরাহকৃত পণ্যের চেয়ে যদি চাহিদা বেশি থাকে, তাহলে চাহিদা বৃদ্ধিজনিত মূল্যস্ফীতি ঘটে।
এত কিছুর পরও মূল্যস্ফীতি রোধে প্রথমেই অর্থের জোগানের রাশ টেনে ধরার কথা বলা হয়। এক্ষেত্রে অনেক উন্নত দেশের গৃহীত নীতির উদাহরণ দেন। যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপে যে কারণে মূল্যস্ফীতি ঘটেছে বাংলাদেশে সে একই কারণে মূল্যস্ফীতি নাও ঘটতে পারে। ফলে তাদের নেয়া পদক্ষেপে সবসময় বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান নাও মিলতে পারে। সবক্ষেত্রে অর্থের জোগানের রাশ টেনে মূল্যস্ফীতি নাও রোধ করা যেতে পারে। তাহলে প্রশ্ন হলো, মূল্যস্ফীতি রোধ সম্ভব কোন পথে?
লেখক: সাংবাদিক
