মাইনে তোমার একশো বারো
অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়
পুলিশ তুমি যতই মারো, মাইনে তোমার একশো বারো: পাঁচ দশক আগে হরেকৃষ্ণ কোঙারের এই বিখ্যাত উক্তি সারা বাংলায় ভাইরাল স্লোগান হয়ে যায়। যখন যে রাজনৈতিক দলই বিরোধী দল থেকেছে পুলিশের জুলুম’কে কটাক্ষ করতে এই উক্তি ব্যবহার করেছে। রাষ্ট্রের পুলিশের বিরুদ্ধে সরকার-বিরোধী দলগুলোর একই অভিযোগ সেই আদিকাল থেকে চলে আসছে। পুলিশের কাজই সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে নজরদারি করা। যে-হেতু আইন তৈরি ও রক্ষার দায়িত্ব শাসকের, ফলে শান্তি বজায় রাখতে পুলিশের কার্যকলাপকে সরকারের নির্দেশে অত্যাচার বলেই ধরা হয়। ও-দিকে সরকারও প্রশাসনের নামে রাজনৈতিক সুবিধা তোলার জন্যে পুলিশকে ব্যবহার করে। পুলিশকে সরকার-বিরোধী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এবং দলের বিরুদ্ধে কাজ করতে বাধ্য করে। অথচ আমার-আপনার মতো মানুষই পুলিশের চাকরি নেয়। অন্য সব সরকারি চাকরির মতোই পুলিশও সরকারের চাকরি করে। কিন্তু তাদের কাজটা এমনই যে নাগরিকের বাহবা পাওয়ার বদলে তাদের নামে জোটে বদনাম।
যখন থেকে সমাজে ক্ষমতাবান মানুষ ভয় দেখিয়ে বা আদেশ করে অন্যদের দিয়ে কাজ করাতে লাগল, তখন থেকেই ভৃত্যের নিয়োগ শুরু। মধ্যযুগের ইতিহাসে যারা ধনী বা বহু সম্পদের অধিকারী, অনেক জমি-পুকুর-খামারবাড়ি রয়েছে তারা কৃষিকাজের জন্য অথবা অন্যান্য কাজের জন্য অন্যদের নিয়োগ করত। এই নিয়োগ দুই ভাবে করা হত, ভয় দেখিয়ে বা আদেশ করে। নিজের ‘চাওয়া’র, অর্থাৎ কোনও আকাঙ্ক্ষিত বস্তু, যারা সংগ্রহ করত তাদের বলা হত, ‘চা-কর’। প্রভুর নির্দেশমতো যারা নতুন কিছু উৎপন্ন বা সংগ্রহ করে আনত, তারা ছিল ‘নওকর’ বা ‘নোকর’। ‘বাকর’-এর কোনও নির্দিষ্ট কাজ ছিল না, চাকরের অনুপস্থিতিতে তারা বিকল্প ছিল, আজকের দিনে ক্যাজুয়াল লেবার। এই কাজগুলোকেই বলা হয় চাকরি-নোকরি-বাকরি। অতএব চাকরি মানেই অন্যের অধীনে, তার আদেশমতো কাজ করা।
সত্যি কথা বলতে কী, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সরকারের মন্ত্রী-আমলা থেকে অধস্তন কর্মচারী, সকলেই জনগণের সেবায় নিযুক্ত সরকারি চাকরিজীবী, কিন্তু ক্ষমতার জেরে মন্ত্রী-আমলারা বেশি সুবিধাভোগী। পুলিশও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে যত রকমের সরকারি চাকরি আছে, সবার চেয়ে অস্বস্তিজনক অবস্থায় থাকে সেনা আর পুলিশ। এদের উপরেই প্রশাসক ও জনগণের চাপ বেশি। এঁরা কেউ ব্যক্তিগত আচার ব্যবহারে নিষ্ঠুর, হিংস্র, বা হত্যাকারী নন, বরং দিনের শেষে সাংসারিক দায়িত্ব পালনকারী, হয়তো সাংস্কৃতিক জগতেও নিয়মিত নিযুক্ত। অথচ তাঁদের কাজটা এমনই যে, প্রয়োজনানুসারে মানুষের ভাল গুণ লুকিয়ে রেখে রাষ্ট্রের নিষ্ঠুর আদেশ পালন করতে হয়। অনেক সময় রাষ্ট্র তার রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যই এই দুই বাহিনীকে ব্যবহার করে। এক দেশের সেনা যখন নির্বিচারে অপর দেশের সেনা এবং সাধারণ নাগরিককে হত্যা করে, তখন জাতীয়তাবোধের উন্মত্ততায় মানবতাবোধ হারিয়ে যায়। আবার দেশের মধ্যে নদী-বাঁধের বিরুদ্ধে জমি হারানো লোকেরা যখন প্রতিবাদ জানায়, বা খনিজ খননের উদ্দেশ্যে যখন অরণ্যবাসীদের উচ্ছেদ বা অরণ্যের অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলে, তখন পুলিশকে দিয়ে অত্যাচার করানো হয়, এমনকি বিক্ষোভ দমনের নামে শান্তির নামে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়, নাগরিক হিসেবেও পুলিশের হাতে লাগে রক্তের দাগ। আশির দশকে গোবিন্দ নিহালনি পরিচালিত ‘অধ্র্? সত্য’ ছবিতে সাহসের সঙ্গে দেখানো হয়েছে সৎ পুলিশকর্মী কী ভাবে অসৎ রাজনীতিজীবীর শিকার হয়ে হিংস্র হয়ে ওঠেন। এ তো আমাদের সমাজেরই ছবি। অথচ এই সেনাবাহিনী প্রাকৃতিক বা অন্য দুর্যোগের সময় প্রাণের বাজি রেখে মানুষের প্রাণ রক্ষা করে। এই পুলিশবাহিনী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে মানুষকে রক্ষা করতে গিয়ে আহত বা নিহতও হয়ে যায়। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আমাদের ক্ষোভ আমাদেরই প্রতিবেশী পুলিশ কর্মচারীটির প্রতি উগরে দিই। তাদের মৃতদেহও কিন্তু নাগরিকেরই দেহ, অসহায় উপার্জনজীবীর দেহ।
অর্থাৎ রাষ্ট্র পুলিশকে ব্যবহার করে, অথবা বলা যায় পুলিশ রাষ্ট্র দ্বারা ব্যবহৃত হয়। তার প্রতিবাদের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয় শৃঙ্খলার নামে। যে-ই ক্ষমতায় থাকুক অন্যান্য সরকারি কর্মচারীর মতোই পুলিশ তার হয়ে কাজ করতে বাধ্য হয়। এই সুযোগটাকে ক্ষমতাসীন শাসক সর্বতো ভাবে কাজে লাগায় আর পুলিশ বিরোধীদের আক্রমণের শিকার হয়। শুধু পুলিশকেই নয়, শাসক সরকারের আইনরক্ষাকারী সব এজেন্সিকেই নিজের সুবিধেমতো ব্যবহার করে। আজকাল এই ব্যবহারের তির প্রধানত বিরোধী দলের দিকেই, তাদের নানা ভাবে হেনস্থা করার জন্য। কিন্তু ভুললে চলবে না যে, এ ব্যবস্থা ব্রিটিশ আমল বা তার আগে থেকেই চলে আসছে। সে সময় ভারতীয় ব্রিটিশ পুলিশই ভারতীয়দের পেটাত, ভারতীয় সেনা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের হত্যা করত।
ব্রিটিশ আইনের নামকরণ বদলে ‘সংহিতা’ নামে আইন করলেই রাষ্ট্রীয় শাসকের চরিত্র পাল্টে যায় না। পুলিশকে দিয়ে অসৎ কাজ করালে পুলিশও নানা অসৎ কাজে লিপ্ত হয়ে যায়, প্রলোভনে অভ্যস্ত হয়ে যায়। সমাজে অনেকেই অসৎ, লোভী। আমরা অধিকাংশই আসলে একশো বারো। কেবল পুলিশের দিকে আঙুল তুললে সহজেই সকলের সমর্থন পাওয়া যায় বলে সে কাজটাই আমরা করি।