গত অর্থবছরে এলটিইউর ১০৯টি কোম্পানি ভ্যাট দিয়েছে ৭৪ হাজার কোটি টাকা
মো. আখতারুজ্জামান : [১] জাতীয় রাজস্ব বোর্ড তাদের বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ) অধীন ১০৯টি কোম্পানির কাছ থেকে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাবদ ৭৪ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। এ কর আহরণ আগের বছরের তুলনায় ২৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
[২] জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তাদের মতে, গ্যাস, বিদ্যুৎ, সিগারেট এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্রমবর্ধমান মূল্যের কারণে এত বেশি ভ্যাট আহরণ করা গেছে।
[৩] তারা বলেন, দীর্ঘদিনের বকেয়া পরিশোধের অংশ হিসেবে পেট্রোবাংলার কাছ থেকে বকেয়া পাঁচ হাজার কোটি টাকা আদায় এ উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে।
[৪] এছাড়াও এনবিআরের বিরোধ নিষ্পত্তি ও আইনি মাধ্যমে মোবাইল ফোন অপারেটর এবং ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে বকেয়া আদায়ের সাফল্যও এ রাজস্ব বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
[৫] এলটিইউ-এর মূল্য সংযোজন কর সংগ্রহ ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১২ শতাংশ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
[৬] এলটিইউ-ভ্যাটের কমিশনার মো. শামসুল ইসলাম বলেন, গ্যাস ও সিগারেটের দাম বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি চলা নিয়মিত প্রবৃদ্ধি এবং নিরীক্ষা ও বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে ভ্যাটের উল্লেখযোগ্য সংযোজন এ শক্তিশালী প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে।
[৭] এছাড়া, পেট্রোবাংলার কাছ থেকে বকেয়া পাঁচ হাজার কোটি টাকা আদায়ও এক্ষেত্রে সহায়তা করেছে বলে জানান কমিশনার।
[৮] তিনি বলেন, গত বছরের বৃদ্ধির হার ২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে গঠিত এলটিইউ-ভ্যাট অফিসের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এর আগে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ২১ শতাংশ।
[৯] এলটিইউ-ভ্যাট অফিসের প্রধান আরও বলেন, পেট্রোবাংলা থেকে পাওয়া বকেয়া বাদ দিলেও রাজস্ব বৃদ্ধি প্রায় ১৭ শতাংশ, যা গত দুই অর্থবছরের বিবেচনায় একটি উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি।
[১০] তামাক শিল্প সরকারি কোষাগারে সর্বোচ্চ ভ্যাট প্রদানকারী খাত। এলটিইউ অফিসের মোট সংগ্রহের প্রায় অর্ধেক আসে এ খাত থেকে।
[১১] ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে সরকার উল্লেখযোগ্যভাবে সিগারেটের দাম বাড়িয়েছিল। এতে দুটি বড় কোম্পানি থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত উপার্জন করা গিয়েছিল। আর মোট ভ্যাট আয় হয়েছিল ৩৫ হাজার কোটি টাকার ওপরে।
[১২] আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মোবাইল ফোন কোম্পানি এবং ব্যাংক থেকে বিরোধপূর্ণ অর্থ সংগ্রহও ভ্যাট বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে। এছাড়া, গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে গ্যাস খাত থেকে ভ্যাট বৃদ্ধি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১৮৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
[১৩] যেসব কোম্পানি বছরে অন্তত পাঁচ কোটি টাকা বা তার বেশি ভ্যাট দেয় সেগুলোর ভ্যাট পরিশোধের তত্ত্বাবধান করে এলটিইউ-ভ্যাট অফিস। ৩৭টি বিভিন্ন খাতের মোট ১১০টি কোম্পানি বর্তমানে এ অফিসের আওতাভুক্ত।
[১৪] এনবিআরের মতে, তামাক শিল্প বৃহৎ করদাতাদের ইউনিটের মূল অবদায়ক। এ খাতের দুটি কোম্পানির সামগ্রিক ভ্যাট ১৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
[১৫] এলটিইউ অফিসের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ওই অফিসে তালিকাভুক্ত তিনটি ইউনিটের মধ্যে দুটি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ লিমিটেডের (বিএটিবি।
[১৬] ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আনুমানিক ৩২ হাজার কোটি টাকার ভ্যাট কেবল বিএটিবি থেকে এসেছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা। বাকি অর্থ এসেছে জাপান টোব্যাকো ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড থেকে। বিএটিবি থেকে মতামত জানার চেষ্টা করলেও প্রতিষ্ঠানটি আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
[১৭] গত বাজেটে সরকার তামাকের দাম এবং সম্পূরক শুল্ক আরও বাড়ায়। এর আওতায় এনবিআর-এর চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে অতিরিক্ত ছয় হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করার লক্ষ্য রয়েছে।
[১৮] এলটিইউ-ভ্যাট অফিস অনুসারে, বৃহত্তম ভ্যাটদাতা সংস্থাগুলে হলো গ্যাস, মোবাইল ফোন, ওষুধ, ব্যাংকিং, বিদ্যুৎ বিতরণ, পানীয়, সিমেন্ট এবং গুদাম শিল্পের ইউনিট। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন শীর্ষ দশের মধ্যে রয়েছে।
[১৯] গত অর্থবছরে গ্যাস খাতের পাঁচটি ইউনিট থেকে রাজস্ব কর্তৃপক্ষ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি সংগ্রহ করেছে। প্রায় ১৬ শতাংশ বৃদ্ধি নিয়ে তৃতীয় বৃহত্তম অবদায়ক মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো, যাদের কাছ থেকে আহরিত ভ্যাটের পরিমাণ প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি।
[২০] রবি আজিয়াটা লিমিটেডের রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্সের প্রধান শাহেদ আলম বলেন, মোবাইল অপারেটরেরা গত অর্থবছরে দুই হাজার ৬০০ মেগাহার্টজ স্পেকট্রাম এবং সরঞ্জামের ওপর বিনিয়োগের জন্য ভ্যাট প্রদান করেছে।
[২১] এছাড়া, প্রায় ৬০০ কোটি টাকা বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে প্রদান করা হয়েছিল। মূল্যস্ফীতিও একটি ভূমিকা পালন করেছে। এসবের ফলে এ খাত থেকে ভ্যাট সংগ্রহের সন্তোষজনক প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তিনি আরও বলেন।
[২২] ভালো প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে বর্তমান অর্থবছরের জন্য সরকার টকটাইম এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের পাশাপাশি মোবাইল সিমের দামে সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি করেছে। তবে কর বৃদ্ধির পরও এ খাত থেকে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি দেখার ক্ষেত্রে আশাবাদী নন শাহেদ আলম।
[২৩] তিনি বলেন, সম্প্রতি আমরা দেশব্যাপী ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের সম্মুখীন হয়েছি যা আমাদের ব্যবসাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এছাড়া, চলমান মুদ্রাস্ফীতির চাপ এ খাতের ব্যবসাকে সংকুচিত করতে পারে। মোবাইল অপারেটরদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রত্যাশিত হারে রাজস্ব আদায় নাও বাড়তে পারে।
[২৪] এদিকে এলটিইউ অফিসে তালিকাভুক্ত ১৭টি ব্যাংকের রাজস্ব বৃদ্ধির পরিমাণ গত অর্থবছরে তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকার বেশি। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, প্রতিদিন ব্যাংকিং লেনদেন বাড়ছে এবং ভ্যাটযোগ্য সেবা সম্প্রসারিত হয়েছে, যে কারণে ব্যাংকিং খাতে ভ্যাট প্রবৃদ্ধি শক্তিশালী হয়েছে।