রাজশাহীতে ব্যবসায় ক্ষতি দিনে শত কোটি টাকা
রাজশাহী প্রতিনিধি : [১] রাজশাহীতে টানা কারফিউতে ক্ষতির মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন আম ব্যবসায়ী ও বাগান মালিকরা। আমের পাশাপাশি পান ও মাছ ব্যবসাতেও ক্ষতির মুখে পড়েছেন চাষি ও ব্যবসায়ীরা। সবমিলিয়ে বিভিন্ন ব্যবসা বাণিজ্যে রাজশাহীতে দৈনিক শতকোটি কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।
[২] অনাকাঙ্ক্ষিত এসব ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন আমের রাজধানী খ্যাত রাজশাহীর আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা। কেননা নগরজুড়ে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করায় জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাড়ির বাইরে বের হননি। আবার কেউ বের হলেও কারফিউয়ের কারণে মোড়ে মোড়ে পুলিশি বাধার মুখোমুখি হচ্ছেন। ফলে হাট-বাজারগুলোতে দেখা দিয়েছে ক্রেতা সংকট।
[৩] এছাড়া ইন্টারনেট না থাকায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অনলাইনে অর্ডার বা বিক্রিও সম্ভব হচ্ছে না। ফলে অধিকাংশ বাগান মালিকের গাছেই পেকে নষ্ট হচ্ছে আম। এতে লোকশানের মুখে পড়তে হচ্ছে তাদের। দুই একদিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে কোটি কোটি টাকা লোকসানের শঙ্কায় রয়েছেন আমচাষিরা। [৪] রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহীতে এবার ১৯ হাজার ৬০২ হেক্টর জামিতে আমের ও সাড়ে ৪ হাজার হেক্টর জমিতে পানের চাষ হয়েছে। এবার আমে কমপক্ষে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং পানে ৩ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ রয়েছে। তবে ট্রাকে করে পান দেশের বিভিন্ন জেলায় রপ্তানি হলেও আমের ক্ষেত্রে সেটি হচ্ছে না। এতে কোটি কোটি টাকা লোকসানের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
[৫] রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আমবাগানি দিলদার হোসেন মৃধা বলেন, বৈরী আবহাওয়ার কারণে এবার আমের উৎপাদন কম ছিল। ফলে শুরু থেকেই আমের দাম ও চাহিদা বেশি ছিল। এখন আমের মৌসুম শেষের দিকে হওয়ায় দাম ও চাহিদা আরও বেড়েছে। কিন্তু দেশের এই পরিস্থিতির কারণে হাট-বাজারে ক্রেতা নেই। যদিও আমি সারাদেশে অনলাইনেই সবচেয়ে বেশি আম ডেলিভারি দিয়ে থাকি। কিন্তু ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। ফলে গাছ থেকে আম নামাতে না পারায় গাছেই আম পেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
[৬] রাজশাহীর সাহেব বাজার এলাকার পাইকারি আম ব্যবসায়ী কোয়েল মিয়া জানান, ফজলি আমের ভরা মৌসুম চলছে। এই সময়ে আমের ভালো ব্যবসা হতো। কিন্তু কারফিউয়ের কারণে ক্রেতা নেই। অনলাইনেও আমের ব্যবসা করতাম। কিন্তু এখন সেটি সম্ভব নয়। গত সোমবার থেকে ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছি।
[৭] বাগমারার তাহেরপুর এলাকার পানবরজের মালিক আব্দুর রাকিব বলেন, ২০ হেক্টর জমিতে এবার পানের বরজ করেছি। প্রতিদিন ভোরে ট্রাকে করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পান রপ্তানি করতাম। কিন্তু কারফিউয়ের কারণে বন্ধ রেখেছি। যদিও অনেকেই পাঠাচ্ছে। কিন্তু রাস্তায় ক্ষতির আশংকায় আমি পান কোথাও পাঠাচ্ছি না। এতে বরজের অনেক পান পেকে যাচ্ছে।
[৮] রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোসা. উম্মে ছালমা বলেন, কারফিউয়ে পানের খুব বেশি ক্ষতি হচ্ছে না। আমি প্রতিনিয়ত খোঁজখবর রাখছি। পানের ট্রাক রাজশাহী থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাচ্ছে। তবে আমের ক্ষেত্রে একটু ক্ষতি হচ্ছে। কেননা কারফিউয়ের কারণে ক্রেতা কম।
[৯] এদিকে রাজশাহী মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এবার রাজশাহীতে প্রায় ১৮ হাজার ৭৫০ হেক্টর পুকুরে (পুকুরের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার) মাছের চাষ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন। এই মাছ রাজধানীসহ দেশের ১৮টি জেলায় রপ্তানি হয়ে থাকে।
[১০] তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কারফিউয়ের কারণে রাজশাহী থেকে কোথাও মাছ রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে প্রতিদিন প্রায় ১০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। দুর্গাপুরের মাছ ব্যবসায়ী আলিমুল ইসলাম বলেন, ১১০ হেক্টর জমির পুকুরে মাছচাষ করেছি। তবে শাটডাউন-কারফিউয়ের কারণে গত প্রায় এক সপ্তাহ থেকে মাছ তোলা বন্ধ রেখেছি। আমি স্বাভাবিক সময়ে প্রায় প্রতিদিন ১০ টন করে মাছ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রপ্তানি করতাম। মাছ তোলা বন্ধ হয়েছে ঠিকই কিন্তু প্রতিদিন মাছকেতো খাবার ঠিকই দিতে হচ্ছে। এতে করে বড় লোকসান গুনতে হচ্ছে।
[১১] রাজশাহী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, মাছ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো যাচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু এতে যে বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে তা কিন্তু নয়। কেননা মাছতো আর নষ্ট হয়নি, পুকুরেই আছে। যদি এক সপ্তাহের বেশি এমন অবস্থা থাকে সেক্ষেত্রে ক্ষতি হবে।
[১২] রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ’র সভাপতি মো. মাসুদুর রহমান রিংকু বলেন, ক্রেতা না থাকার কারণে বর্তমানে বাজারের ফজলি আম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট ও রাজশাহীর বানেশ্বর হাট সবচেয়ে বড় আমের হাট। এই দুটি আমের হাট ক্রেতাশূন্য। এছাড়া রাজশাহীর মাছ শিল্প খুবই প্রসিদ্ধ। ঢাকাসহ দেশের ১৮টি জেলায় মাছ যায়। প্রতিদিন ৮-১০ কোটি টাকার মাছের ট্রাক দেশের বিভিন্ন জেলায় যায়। কিন্তু সেটি একেবারেই বন্ধ। পান পরিবহনও বন্ধ রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে পারছে না। সবমিলিয়ে রাজশাহীতে দৈনিক শতকোটি কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে।