
কী সংস্কার চান? সংস্কার-প্রস্তাব কোথায়? কাদের জন্য কতো পার্সেন্ট কোটা সংরক্ষণের প্রস্তাব আপনারা দিয়েছিলেন?

পুলক ঘটক
আওয়ামী লীগ সরকার জনতুষ্টিবাদী কৌশল নিয়ে ২০১৮ সাল থেকেই কোটাবিরোধীদের সঙ্গে আপোস করে পথ চলছে; এবারও তাই করলো। আমি এ আপোসকে ন্যায়সঙ্গত মনে করি না। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি, চরমপন্থী বাম, মধ্যপন্থী বাম, ডানপন্থী বাম সবাই মিলে চাকরিতে কোটার বিরুদ্ধে কথা বললে যদি আর কেউ বাকি থাকে তবে আমি সেই অতি-সংখ্যালঘুদের একজন যে কোটা উচ্ছেদের বিপক্ষে। আমি ২০১৮ সাল থেকেই সরকারি চাকরিতে কোটা সংরক্ষণের বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল অপরাজনীতির বিপক্ষে কথা বলছি; বারবার লিখেছি। এই নৈরাজ্যবাদী আন্দোলনের চরম জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও একদিনের জন্য নিজের অবস্থান পরিবর্তন করিনি। সুবিধাবাদী জনতুষ্টিবাদী পন্থাকে অবজ্ঞা করায় এই ইস্যুতেও প্রান্তিক পর্যায়ের সংখ্যালঘু থেকে গেলাম। মতাদর্শগত সংখ্যালঘু অবস্থান থেকেই নিজের মতামত প্রকাশ করে যাব। আমার কিছু বন্ধু দাবি করেন, তারা নাকি কোটা উচ্ছেদের পক্ষে নয়; সংস্কারের পক্ষে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালে কোটা উচ্ছেদের ঘোষণা দেওয়ার পর এরাই কিন্তু বিজয় মিছিল করেছিল। যা হোক, ধরে নিলাম তারা কোটা সংস্কারের পক্ষে। কিন্তু কী সংস্কার চান? সংস্কার-প্রস্তাব কোথায়? কাদের জন্য কত পার্সেন্ট কোটা সংরক্ষণের প্রস্তাব আপনারা দিয়েছিলেন?
সরকার ২০১৮ সালে কোটা বাতিল করার পরেও আপনারা কি কোনো সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিলেন? ২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল এই ছয় বছরেও এমন কোনো ‘মেধাবী’ ছাত্র সংগঠন কি পেয়েছি, যারা সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিল? ডান-বাম এমন একটি রাজনৈতিক দলও কি আছে, যারা জাতির সামনে কোটা সংস্কারের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব উত্থাপন করেছিল? দেশে সিভিল সার্ভিসে বছরে গড়ে প্রায় ৩ হাজার পদে নিয়োগ হয়। এর বিপরীতে বছরে ৪ লাখ ছেলে মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে বের হয়। মাত্র এই তিন হাজার পদের সবগুলোতে কোটা ছাড়া নিয়োগ হলেও বিপুল সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীর কোনো লাভ নেই। এদেরকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। বাকি থাকে কেরানী, পিয়ন দাড়োয়ান, সুইপার ইত্যাদি পদ। কোটা থাকলেও এসব পদে মেধার ঘাটতি হওয়ার কিছু ছিল না। মেধাবী কেরানী, মেধাবী পিয়ন, মেধাবী দারোয়ান, মেধাবী সুইপার নিয়োগের জন্য কোটা বাতিলের আন্দোলন যৌক্তিক হতে পারে না। এই ছাত্ররা আসলে কেউ সে অর্থে মেধাবী নয়। মেধাবী হলে বিজ্ঞানী বা তেমন কিছু হওয়ার কথা ভাবতো। তারা সবাই ঘুষের মাধ্যমে লাভবান হওয়ার মতো সরকারি চাকরি খোঁজে। তাদের দাবির মধ্যে আদর্শবোধ নেই। বরং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা ব্যবস্থাই মানবিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার অংশ। তা নিশ্চিত করার জন্য যৌক্তিক কোটা সংস্কারের প্রস্তাব একটি দলও দেয়নি। শুধু মানুষকে উস্কে দেওয়ার জন্য সবাই নানারকম বাটপারি খেলায় যুক্ত ছিল।
নিজেদেরকে কোটা সংস্কারবাদী দাবি করা এদের নিছক বাটপারি। আমি কেন কোটা উচ্ছেদ আন্দোলনের বিপক্ষে? শুধু দুটো প্রধান কারণ বলছি। [১] কোটার বিরোধিতা করা মানে দুর্বলের অধিকার সংরক্ষণের বিরোধিতা করা। এ চিন্তা ভাল মানুষের হতে পারে না। যার শক্তি আছে সে টিকে থাকবে, যে দুর্বল সে খেয়ে পড়ে বাঁচার সুযোগ পাবে না, ‘ংঁৎারাধষ ড়ভ ঃযব ভরঃঃবংঃ’ জীবনধারণের নিয়ম হবে এসব জল ও জঙ্গলের জীবন ব্যবস্থা। জলাশয়ে বড় মাছ ছোট মাছকে গিলে খাওয়া নিয়ম। জঙ্গলে দাঁতাল প্রাণিরা নিরীহ প্রাণীদের চিবিয়ে খাওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। এই জংলি জীবন থেকে বেরিয়ে এসেই মানুষ মানব-সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছে স্নেহ, প্রেম, করুণার সমাজ রচনা করেছে– যেখানে দুর্বলের অধিকার সংরক্ষণই সভ্যতা। এর বিরোধিতা করাকে সভ্যতা মনে করি না। [২] কোটা উচ্ছেদের জন্য আন্দোলনকারীদের আমি একদিনও বিশ্বাস করিনি। প্রথম দিন থেকেই বুঝেছি, এর নেপথ্যে আছে প্রতিক্রিয়াশীল জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্র শিবির। তাদের সকল সেন্টিমেন্ট মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে, নারীর সমঅধিকারের বিরুদ্ধে, সংখ্যালঘুদের সমঅধিকারের বিরুদ্ধে, প্রতিবন্ধী ও দুর্বল জনগোষ্ঠীর সমঅধিকারের বিরুদ্ধে। অথচ নিজেদের নামটি কিন্তু দিয়েছে, ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’।
এই নামের আড়ালে কৌশলী প্রচেষ্টা হল দুর্বলের সমঅধিকার কেড়ে নেওয়া। দুর্বলের সমঅধিকার কিভাবে কেড়ে নেওয়া যায়? যদি তাদের জন্য সংরক্ষিত সুযোগ অপসারণ করা যায়, তবেই তাদের অধিকার কেড়ে নেওয়া যায়। তাই সমঅধিকারের নাম করে সকল দুর্বল জনগোষ্ঠীর অধিকার কেড়ে নেওয়ার আন্দোলন হল কোটা বিরোধী আন্দোলন। এক পা না থাকা একজন মেধাবী মানুষ যাতে ১০ তলা ভবনে উঠে অন্যদের সাথে কাজে যোগদানের সুযোগ না পায় সে উদ্দেশ্যে বিল্ডিংয়ে ওঠার বিশেষ লিফট ধ্বংস করার নাম কোটা আন্দোলন। আমি লিখেছিলাম, ‘চাকরিতে নারী ও পুরুষ কোটা সমান ভাগ করে দিলে সমঅধিকার হবে। মেধাভিত্তিক সকল কাজে ৫০% নারী, ৫০% পুরুষ। বৈষম্য নেই।’ একথা লেখায় তথাকথিত সেই ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ সমর্থকরা আমাকে গালি দিয়েছে। লিখেছিলাম, ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পর্যায়ে ৩০% কোটা বাদ দিয়ে নারীদের জন্য ৩৫% কোটা চালু করুন। তাতে কারও ক্ষতি হবে না, কারণ সবার ঘরে নারী আছে। শিক্ষিত মেধাবী নারীদের ৩৫ শতাংশ কর্মক্ষেত্রে তথা অর্থনৈতিক জীবনের মূলধারায় চলে আসলে বাংলাদেশ উপকৃত হবে। দেশে নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি হলেও সরকারি চাকরিতে নারীদের অবস্থান এখনো ১০ শতাংশের নিচে আছে।’ এ কথা লেখার কারণেও তথাকথিত বৈষম্যবিরোধী টাউটের দল আমাকে গালি দিয়েছে। কারণ তাদের লক্ষ্যই হল, নারী-পুরুষ বৈষম্য। নারী শিক্ষার হার বাড়লেও তারা যেন বড়জোর ‘শিক্ষিত গৃহিণী’ হয় এই তাদের চাওয়া। পুরোপুরি তালেবানি রাষ্ট্র করতে পারলে অবশ্য নারীর উচ্চ শিক্ষার সুযোগও কেড়ে নেবে। কোটা সংরক্ষণ না করলে নারীদের সমঅবস্থানে এগিয়ে আনা সুদূর পরাহত হবে এটা তারা বোঝে। বোঝে জন্যই নারী কোটার বিরোধিতা করে।
দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ক্রমাগত কমছে। সরকারি চাকরিতে ৪% এর বেশি সংখ্যালঘু পাওয়া যাবে না। এদের সংরক্ষণের জন্য কোটা দরকার। তবুও সংখ্যালঘুদের জন্য কোটা সংরক্ষণের বিরোধীতা করবে, কারণ তারা দেশ থেকে সংখ্যালঘুদের বিলুপ্তি চায়, তালেবানি রাষ্ট্র চায়। মুক্তিযোদ্ধার নাতি-পুতিদের জন্য ৩০% কোটা সৃষ্টি করা আওয়ামী লীগের একটি আজগুবি সিদ্ধান্ত ছিল; বাজে সিদ্ধান্ত ছিল। এটারই সুযোগ নিয়ে কোটা বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে জনগণকে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে। এমন মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংস্কার করার কথা আমি বহুবার লিখেছি। দরিদ্রদের জন্য সরকারি চাকরির কোটা সংরক্ষণের কথা বলেছি; কোটা ব্যবস্থার প্রগতিশীল সংস্কারের পক্ষে মতামত দিয়েছি। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী প্রতারকদের তা পছন্দ হয়নি। সুতরাং মতাদর্শের জায়গায় আমি সংখ্যালঘুই থেকে গেলাম। এতেই আমার স্বাচ্ছন্দ। সরকার ৯৩% কোটা উচ্ছেদ করেছে। আমি এই ৯৩% কোটার সুষম বন্টনের দাবিতে আজকের প্রতিকূল দিনেও আমার সুস্পষ্ট উচ্চারণ রেখে যাচ্ছি।
লেখক: সাংবাদিক। ২৬-৭-২৪। যঃঃঢ়ং://িি.িভধপবনড়ড়শ.পড়স/মযধঃধপশ
