
জলবায়ু সংকট, বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং আমাদের উপলব্ধি

জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস : গ্লোবাল ওয়ার্মিং চলছে যা আমরা এখন এটি সঠিকভাবে উপলব্ধি করেছি। ১৯৭৬ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত গড় তাপমাত্রা জানুয়ারি ব্যতীত বছরের প্রায় ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। শুষ্ক মৌসুম ছাড়া বর্ষাকালে বৃষ্টিপাত বেড়ে যায়। এটি ছিল ২৯ বছর ধরে ঘটে যাওয়া পরিবর্তন। সুতরাং ২০০৬ থেকে তারিখ পর্যন্ত কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন অবশ্যই হয়েছে। ২০০৭ সালে আইপিসিসি অনুমান অনুযায়ী, গড় তাপমাত্রা ২০১০ থেকে ২০৩৯ থেকে ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি মাসে ১.১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও জিএইচজি নির্গমনের কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় জুন-আগস্টের মধ্যে ০.৫৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। ২০৪০ থেকে ২০৬৯ সাল পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট গড় তাপমাত্রা ৩.১৬ ও ১.১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস হবে।
প্রচলিত কৃষি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শুধু ফসলের জন্যই নয় শতাব্দীর শেষ দিকে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন পরিস্থিতি সহ্যের বাইরে হবে বলে আশা করা হচ্ছে। আরেকটি সমস্যা: পৃথিবীর পৃষ্ঠের এক চতুর্থাংশ সমুদ্রে রয়ে গেছে। ১৯৭৯ সালে স্যাটেলাইট সিস্টেম ব্যবহার শুরু হওয়ার আগে প্রকৃত তাপমাত্রা পাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। তাই প্রকৃত তাপমাত্রা আনুমানিক তাপমাত্রার চেয়ে কম হতে পারে। এই কারণেই হতে পারে বিশেষ করে আমাদের প্রধান খাদ্যশস্যের ধানের ফলন এখনও সিমুলেশন ফলাফল অনুযায়ী প্রভাবিত হয় না। কারণ বর্তমান চাষাবাদের আওতাধীন ফসলের জেনেটিক মেকআপ ভালো। কিন্তু তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ না করলে এই জেনেটিক মেকআপ ও কৃষি সংক্রান্ত অনুশীলন ভবিষ্যতে কার্যকর নাও হতে পারে। এখনও পর্যন্ত যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে তা ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় ও এর মতো কিছু প্রভাব তৈরি করতে যথেষ্ট। বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের তীরে দাঁড়িয়ে আছে।
স্থল স্তরের দুই-তৃতীয়াংশ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৫ ফুটের বেশি উঁচু নয়। তা ছাড়া উপকূলীয় বলয় প্রায় সমুদ্রপৃষ্ঠে। ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় ৫০ সেন্টিমিটার বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে যদি একই ক্রমবর্ধমান প্রবণতায় বিশ্ব উষ্ণায়নের অগ্রগতি হয়। তাহলে উপকূলীয় অঞ্চলের বিপুল জনসংখ্যাকে (সাতটির মধ্যে একটি) কোথাও বসতি স্থাপন করতে হবে। বৈজ্ঞানিক আমেরিকান অনুসারে: বাস্তবতা আরও বিপজ্জনক হতে পারে। ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১.৫ থেকে ২.০ মিটারে উন্নীত হবে। ফলস্বরূপ, বিপুল সংখ্যক মানুষ থাকবে যাদের জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জীবন গ্রহণ করতে হবে। ভেসে যাবে সুন্দরবন, নোনা পানিতে তলিয়ে যাবে বিশাল এলাকা। পানীয় জলের তীব্র সংকট দেখা দেবে। তাহলে উপকূলীয় অঞ্চলের সব মানুষ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বে। বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে বৃষ্টিপাত বেড়েছে কিন্তু সারা বছর সমানভাবে বিতরণ করা হয়নি।
হিমালয়ের হিমবাহ গলে যাচ্ছে। তাই নদীতে পানির পরিমাণও বাড়ছে। তবে মাটি (পলি) ভেসে যাওয়ায় নদীর গভীরতা কমছে। তাই নদীগুলো হিমালয় থেকে নেমে আসা পর্যাপ্ত জলকে মিটমাট করতে পারে না। তাই নদী ভাঙ্গন খুবই স্বাভাবিক। উপচে পড়ছে হাওর ও নদী। নদীগুলো পথ পাল্টে সমুদ্রের দিকে যাচ্ছে। বন্যা অববাহিকা পরিবর্তনের প্রক্রিয়াধীন। তাই দিন দিন ঝুঁকি বাড়ছে। তাই লাখ লাখ মানুষকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ স্থান থেকে কম ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে যেতে হচ্ছে। সাধারণত, তাদের শহরের বস্তিতে আশ্রয় নিতে হয়, প্রধানত রাজধানী যেখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৭ হাজারের বেশি। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা ও সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানও দুর্যোগের জন্য দায়ী। গত দুই দশকে বাংলাদেশে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়গুলো এই বক্তব্যকে সমর্থন করে। ২০০৭ সালে সিডর ৩০৪৬ প্রাণ দাবি করে। ২০০৯ সালে আইলা নামক আরেকটি ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় অঞ্চলের ২ লাখ ঘরবাড়ি ভেসে যায় ও ১৯০ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৬ সালে রোয়ানার কারণে বিশাল এলাকা লবণাক্ত পানির নিচে চলে যায়। পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন ও ২৬ জন মারা গেছেন। দীর্ঘস্থায়ী (৩৬ ঘণ্টা) ঘূর্ণিঝড় বুলবুল ২০১৯ সালে সমগ্র দেশকে বিশৃঙ্খল করে তুলেছিল। প্রায় ২০ লাখ মানুষ নিরাপদ স্থানে স্থানান্তরিত হয়েছে। ঠিক এক বছর পর ঘূর্ণিঝড় আম্পান ধ্বংস করে এক লাখ সত্তর হাজার হেক্টর ফসলি জমি। দশ জনের মৃত্যু হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ২০২১ সালে আঘাত হানে। খুব সম্প্রতি, ঘূর্ণিঝড় রিমালে উপকূলীয় অঞ্চলে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছিল। আজকাল তীব্রতা সত্ত্বেও মানুষের প্রাণহানি কম। কিন্তু ১৯৭০ সালে ভোলা ঘূর্ণিঝড়ে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ মারা যায়।
১৯৯১ সালে চট্টগ্রামের ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। সেই ঘূর্ণিঝড়গুলোর তুলনায় প্রযুক্তিগত উন্নতির কারণে পরবর্তী ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানি খুবই কম। বাংলাদেশের মোট গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমনের মাত্র ০.৫৬ শতাংশ অবদান রাখে। তবে, জার্মান ওয়াচ-এর ২০২১ গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স অনুসারে, বাংলাদেশ বিশ্বের সপ্তম সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে স্থান পেয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের সাধারণ জনগণ সে সম্পর্কে তেমন সচেতন নয়। গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করে যদি আমরা এখনই উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি। তাহলে গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাবে আমরা টিকিয়ে রাখতে পারবো না। লেখক: মহাপরিচালক (সাবেক), নির্বাহী পরিচালক (সাবেক), কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন।
অনুবাদ : জান্নাতুল ফেরদৌস। সূত্র : দি ডেইলি সান
