সুনামগঞ্জে হাওরে আগাম বন্যা ও পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় ২ হাজার ৬৫ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব বাপাউবো’র
এস.ইসলাম জয় : [১] সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলে আগাম বন্যা ও সমন্বিত পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় ২ হাজার ৬৫ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো)।
[২] পরিকল্পনা কমিশনে সেচ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব এনামূল হক প্রকল্পটির প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। সুনামগঞ্জ জেলার হাওর অঞ্চলের আগাম বন্যা ও সমন্বিত পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন (১ম পর্যায়) শীর্ষক প্রকল্পের ওপর ১০ জুলাই একটি পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয় কমিশনে।
[৩] তিনি বলেন, প্রস্তাবিত প্রকল্পটির মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ২ হাজার ৬৪ কোটি ৯০ লাখ কোটি টাকা। বাস্তবায়নকাল অক্টোবর ২০২৩ হতে জুন ২০২৭ পর্যন্ত। প্রকল্পটি সম্পূর্ণ জিওবি অর্থায়নে প্রস্তাব করা হয়েছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বাপাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ইমদাদুল হক প্রকল্পটির বিস্তারিত বিবরণ ওই সভায় তুলে ধরেন।
[৪] আলোচনা সভায় প্রকল্পটি গ্রহণের যৌক্তিকতার বিষয়ে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী খুশী মোহন সরকার জানান যে, সুনামগঞ্জ জেলা সকল প্রকার কৃষিজ পণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশে সুপরিচিত। শুষ্ক মৌসুমে এই অঞ্চলের হাওরে প্রচুর পরিমাণ ফসল উৎপাদিত হয়। হাওর অঞ্চলে আগাম বন্যার প্রকোপ হতে বোরো ফসল রক্ষা, মৎস্য চাষ ও নৌ চলাচলের সুবিধার্থে পরিকল্পনা অনুযায়ী বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক ডুবন্ত বাঁধ নির্মাণ করা হয়।
[৫] প্রতিবছরই ডুবন্ত বাঁধ বিভিন্ন মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্থ হয় বিধায় প্রতিবছর বর্ষা শেষে বাঁধের ক্ষতিগ্রস্থ অংশগুলো মেরামত করা হয়। ভৌগলিক অবস্থানগত কারনে সুনামগঞ্জ অঞ্চলে আকস্মিক বন্যায় বোরো ফসলসহ অন্যান্য শস্য এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ফ্লাস ফ্লাডের পানি সুনামগঞ্জ জেলায় একত্রিত হয় এবং এখান থেকে ভাটির দিকে নিষ্কাশিত হতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়।
[৬] সুরমা নদীসহ অন্যান্য নদীর তলদেশ পলি ভরে ভরাট হয়ে যাওয়ায় এবং যায়গায় যায়গায় নদীর তলদেশে পাহাড় হতে ধাবিত বালু স্থিত হয়ে ডুবচর পরে যাওয়ায় নদীগুলোর নিষ্কাশন ক্ষমতা অনেক কমে গেছে। এ কারণে ফ্লাস ফ্লাডের পানি নিষ্কাশিত হতে অতিরিক্ত সময় লাগে। এছাড়া হাওরের সঙ্গে নদীর সংযোগকারী খালগুলোর তলা ভরাট হয়ে গেছে। এর ফলে বর্ষা পরবর্তী হাওরের পানি নিষ্কাশনে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। এতে করে পরবর্তী বোরো মৌসুমে বীজতলা প্রস্তুতকরণ ও চারা রোপণের সময় আরো সংক্ষিপ্ত হয়ে আসে। এ অবস্থায় হাওর অঞ্চলে নদ নদী গুলোর ড্রেজিং এর মাধ্যমে নিষ্কাশন ক্ষমতা বৃদ্ধিসহ অন্তর্র্বতী খালগুলো খনন করা প্রয়োজন।
[৭] ওই সভায় পরিকল্পনা কমিশনের অতিরিক্ত সচিব (সেচ) মহা. এনামূল হক বলেন, যেহেতু প্রস্তাবিত প্রকল্পটি সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলার ১৮টি উপজেলায় বাস্তবায়িত হবে। সেহেতু প্রকল্পের শিরোনাম হতে শুধু সুনামগঞ্জ জেলা অংশ বাদ দিয়ে হাওর অঞ্চলের আগাম বন্যা ও সমন্বিত পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন (১ম পর্যায়) রাখা প্রয়োজন। এছাড়া প্রকল্পের অঙ্গভিত্তিক ব্যয় বিভাজনে সরবরাহ ও সেবা খাতের একক ও পরিমাণে থোক এর পরিবর্তে সুনির্দিষ্ট পরিমাণ উল্লেখ করা প্রয়োজন। এছাড়া প্রস্তাবিত প্রকল্পের ড্রেজিংকৃত স্থানে পলি পড়ার হার কেমন ও আগামী ৬ বছরে ওই স্থানে কি পরিমাণ পলি জমা হবে এবং রক্ষণাবেক্ষণ করতে প্রতি বছর কি পরিমাণ ব্যয় হবে তার বিস্তারিত বিবরণ ডিপিপিতে উল্লেখ করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।
[৮] কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রধান মো. ছায়েদুজ্জামান বলেন যে, প্রকল্পের অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে ব্যয়ের পরিমাণ যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের এ্যালোকেশন অব বিজনেস এর আওতাধীন না হওয়ায় প্রকল্পে প্রস্তাবিত ১টি ব্রিজ নির্মাণ বাবদ ১২.৬৩ কোটি, ১৪টি ভিলেজ প্লাটফর্ম নির্মাণ বাবদ ১৫.৫২ কোটি, ৩৩ হাজার ৩৮১টি বৃক্ষরোপণ বাবদ ২ কোটি, ৩৭০টি বজ্র নিরোধক পোল স্থাপন বাবদ ২২.৪০ কোটি টাকা বাদ দেওয় হয়।
[৯] এছাড়া, অর্থ বিভাগের গত ৪ জুলাই “২০২৪-২৫ অর্থবছরের পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের কতিপয় ব্যয় স্থগিত/হ্রাসকরণ ও বিদেশ ভ্রমণ সীমিতকরণ” সংক্রান্ত সর্বশেষ পরিপত্র অনুযায়ী বৈদেশিক প্রশিক্ষণ/ভ্রমণ খাতে প্রস্তাবিত ৩.৬০ কোটি টাকা, ১টি জীপ ক্রয় বাবদ ১.৪৫ কোটি টাকা এবং ২টি ডাবন কেবিন পিক-আপ ক্রয় বাবদ ১.১০ কোটি টাকা বাদ দেয়ার সুপারিশ করা হয়। তবে জনবল নির্ধারণ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী (পরিবহন সেবা হিসেবে) জীপ গাড়ী ও ডাবল কেবিন পিক-আপ ক্রয়/ভাড়ার বিষয়টি সংযুক্ত করা যেতে পারে মত দেন আলোচকরা। এছাড়া, ফসলের ক্ষতিপূরণ বাবদ ২৫ কোটি টাকা, রেস্ট হাউজ নির্মাণ বাবদ ১.৫০ কোটি টাকা এবং অন্যান্য ভবন ও স্থাপনা বাবদ ৮০ লাখ টাকার মধ্যে সীমিত রেখে ডিপিপি পুনর্গঠন করা প্রয়োজন।
[১০] প্রস্তাবিত প্রকল্পের ২ বছর ৭ মাস মেয়াদে ৫০৪.৮০ লাখ ঘনমিটার (১২০৯.২৭ কোটি টাকা) নদী ড্রেজিং কাজ ভাড়া করা ড্রেজার দ্বারা এবং ৩৪০.৩৫ লাখ ঘনমিটার (৩৩০.৬২ কোটি টাকা) বাপাউবো’র নিজস্ব ড্রেজার দ্বারা ড্রেজিং এর প্রস্তাব করা হয়েছে। যেহেতু প্রকল্পটি ৪ (চার) বছর মেয়াদে সম্পন্ন করা হবে তাই অর্থ সাশ্রয়ের লক্ষ্যে ও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে প্রস্তাবিত প্রকল্পের ৫২৫ লাখ ঘনমিটার (৫১০ কোটি টাকা) বাপাউবো’র নিজস্ব ড্রেজার দ্বারা ড্রেজিং করা প্রয়োজন এবং ৩২০.১৫ লাখ ঘনমিটার (৭৬৬.৯৩ কোটি টাকা) নদী ড্রেজিং কাজ ভাড়া করা ড্রেজার দ্বারা ড্রেজিং করা সমীচীন হবে।
[১১] এ বিষয়ে সভায় সকলে একমত পোষণ করেন। ৩.৫ প্রকল্পের ৮.৩৭৩ কিলোমিটার সিসি ব্লক আর্মারিং কাজ অন্তর্ভুক্ত আছে। কাজের স্থায়ীত্ব বৃদ্ধির জন্য ব্লকগুলো ইন্টারলকিং করার বিষয়ে সভায় আলোচনা হয়। সিসি ব্লক আর্মারিং কাজের ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত এলাকার ১/২টি স্থানে ব্লকগুলোর মধ্যে ইন্টারলকিং ব্যবস্থা করার মাধ্যমে পাইলটিং করার বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত করে ডিপিপি পুনর্গঠন করা বিষয়ে আলোচনা হয়।
[১২] প্রস্তাবিত প্রকল্পের মেয়াদ ডিসেম্বর ২০২৩ হতে জুন ২০২৬ পর্যন্ত রাখা হয়েছে। প্রকল্পটি আরম্ভের মেয়াদ ইতোমধ্যে শেষ হওয়ায় জুলাই ২০২৪ হতে জুন ২০২৮ পর্যন্ত নির্ধারণ করা যেতে পারে বলে মত দেওয়া হয় সভায়।
[১৩] কমিশনের সুপারিশ সুনামগঞ্জ জেলার হাওর অঞ্চলের আগাম বন্যা ও সমন্বিত পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন (১ম পর্যায়) শীর্ষক প্রকল্পটি নিম্নোক্ত বিষয় বিবেচনায় ডিপিপিটি অনুমোদনের লক্ষ্যে সুপারিশ করা যায়। প্রস্তাবিত প্রকল্পটি সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলার বাস্তবায়িত হবে বিধায় প্রকল্পের শিরোনাম হতে সুনামগঞ্জ জেলা অংশ বাদ দিয়ে “হাওর অঞ্চলের আগাম বন্যা ও সমন্বিত পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন (১ম পর্যায়)” রাখা যেতে পারে। প্রস্তাবিত প্রকল্পের ড্রেজিংকৃত স্থানে পলি পড়ার হার কেমন ও আগামী ৬ বছরে উক্ত স্থানে কি পরিমাণ পলি জমা হবে এবং রক্ষণাবেক্ষণ করতে প্রতি বছর কি পরিমাণ ব্যয় হবে তার বিস্তারিত বিবরণ ডিপিপিতে উল্লেখ করতে হবে।
[১৪] প্রস্তাবিত প্রকল্পের ব্রিজ নির্মাণ, ভিলেজ প্লাটফর্ম নির্মাণ, বৃক্ষরোপণ, বজ্র নিরোধক পোল স্থাপন, জীপ ক্রয়, ডাবন কেবিন পিক-আপ ক্রয় এবং বন্যা ব্যবস্থাপনা ও পানি সম্পদ বিষয়ে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের জন্যে ও প্রশিক্ষণ গ্রহণার্থে বৈদেশিক ভ্রমণের সংস্থানকৃত ব্যয় বাদ দিয়ে ডিপিপি পুনর্গঠন করতে হবে।
[১৫] তবে জনবল নির্ধারণ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী (পরিবহন সেবা হিসেবে) জীপ গাড়ী ও ডাবল কেবিন পিক-আপ ক্রয়/ভাড়ার বিষয়টি সংযুক্ত করা যেতে পারে। প্রস্তাবিত প্রকল্পের ৫২৫ লাখ ঘনমিটার (৫১০ কোটি টাকা) বাপাউবো’র নিজস্ব ড্রেজার দ্বারা ড্রেজিং করতে হবে এবং ৩২০.১৫ লাখ ঘনমিটার (৭৬৬.৯৩ কোটি টাকা) নদী ড্রেজিং কাজ ভাড়া করা ড্রেজার দ্বারা ড্রেজিং করতে হবে।
[১৬] প্রস্তাবিত প্রকল্পের ফসলের ক্ষতিপূরণ বাবদ ২৫ কোটি টাকা, রেস্ট হাউজ নির্মাণ বাবদ ১.৫০ কোটি টাকা এবং অন্যান্য ভবন ও স্থাপনা বাবদ ৮০ লাখ টাকার মধ্যে সীমিত রেখে ডিপিপি পুনর্গঠন করতে হবে।
[১৭] উল্লেখ্য যে, পিইসি সভার পূর্বেই পূর্বানুমোদন গ্রহণ করতে হবে। প্রকল্পটি আরম্ভের মেয়াদ জুলাই ২০২৪ হতে জুন ২০২৮ পর্যন্ত নির্ধারণ করতে হবে।