দুই পক্ষের চাওয়ায় পার্থক্য ছিলো খুব কম, তবুও কেন এমন সহিংসতা?
গুলজার হোসেন উজ্জ্বল
এখানে ছবিগুলো আছে সবগুলো ছবিই বেদনার। নৃশংসতার। এই মানুষগুলোকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার মোটিভ বিবেচনা করলে আমরা দেখতে পাবো কিছু হত্যা উত্তেজিত হয়ে, ইম্পালসিভ হয়ে অথবা কনসেকুয়েন্স হিসেবে ঘটে যাওয়া ঘটনা। কিছু হত্যা তার চেয়ে করুণ। পিটিয়ে পিটিয়ে মারা। সেই পেটানোটা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করা। মৃতদেহ নিয়ে উল্লাস করা, উলটো করে ঝুলিয়ে দেওয়া এগুলো প্রমাণ করে এখানে করুণা, মায়ার কোনো ছিটেফোঁটাও ছিলো না। যেমনটা বৃটিশরা করেছিল সিপাহী বিদ্রোহের সময় বা কারবালায় করেছিল ইমাম হোসাইনের হত্যাকারীরা তার কাটা মুণ্ডু নিয়ে। সেসময় আরবেরা হত্যার পর ‘মুসলা’ করতো। মুসলা মানে মৃতদেহ টুকরা টুকরা করা। সে সময়ে আরবে এটা ছিল একটা চালু ট্রেন্ড। এটা দিয়ে মৃতদেহকে অসম্মান করা হতো। হত্যা মানে শাস্তি বা প্রতিশোধ। মুসলা তারচেয়ে বেশি কিছু। চরমতম প্রতিশোধ যা কেবল হত্যা করে হয় না, আরো বেশি কিছু লাগে। আরো বেশি ক্রোধ, আরো বেশি বর্বরতার ছাপ রাখা হলো।
আরো ছবি দিতে পারতাম। দিলাম না। আপনারা সেসব এমনিতেই দেখেছেন। ফেসবুকের টাইম লাইনজুড়ে এসবই। কে কোন দলের সেটা মাথায় না রাখলে সবগুলো ছবিই আপনাকে কষ্ট দেবার কথা। একজন মানবিক মানুষ হিসেবে প্রতিটি ছবিতেই আপনার কষ্ট পাবার কথা ছিল এবং আপনি প্রথমেই চাইতেন শান্তি। কিন্তু আপনি আসলে তা করবেন না। কিছু ছবি দেখে কষ্ট পাবেন। কিছু ছবি দেখে মজা পাবেন। আসলে মানুষ তার আদিম পূর্বপুরুষের জেনেটিক বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে এবং বিভিন্নভাবে তার জানান দেয়। তারা ইগো দ্বারা পরিচালিত হয়। হত্যার বদলে হত্যা, রক্তের বদলে রক্ত চায়। একটা বিপুল অংশের মানুষ উত্তেজনাসক্ত। তাই তারা এই ধারাবাহিক মৃত্যু ও সহিংসতার পরের পর্ব দেখবার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, অনেকটা সিরিয়াল দেখার মতো। রাষ্ট্র ও ছাত্রপক্ষের এই দ্বৈরথ এখানেই থেমে যাক তারা চায় না। তারা সংলাপ চায় না। মীমাংসা চায় না। তারা চায় পুনরায় কর্মসূচি, আরো আল্টিমেটাম। সব মানুষ আসলে শান্তি চায় না। বেশির ভাগ মানুষই চায় এড্রেনালিন রাশ। তাই তার অন্নের চাওয়া মিটে গেলে সে চায় সূরা, যৌনতা ইত্যাদি। রাতে ভাত খেয়ে ঘুমানোর আগে বউয়ের সাথে ঝগড়া করতে চায়। পুকুরঘাটে গেলে প্রতিবেশির নামে বদনাম করতে চায়। এগুলো হিউম্যান ইন্সটিংক্ট। তার লাইফের একধরনের চার্ম। যারা শুধু উত্তেজনা চায় তারা ঝুঁকি নেয় না। দূর থেকে উস্কানি দেয়। দর্শকের মতো। কিছু মানুষ ঝুঁকি নেয়। তারা এই উত্তেজক গল্পের নায়ক। কিছু মানুষ ডিল করতে চায়। জটিল চাল দিয়ে রাজা চেক দিতে চায়। আমার পাঁচ হাজার বন্ধুর মধ্যে স্রেফ শান্তি ও স্বস্তি চান এমন মানুষ পাঁচজনকেও পেলাম না। অথচ সেটা খুব কঠিন কিছু না। আপনাদের উত্তেজনাসক্তি কেটে গেলে দেখতে পাবেন
রাষ্ট্রের বর্তমান ঘটনায় দুপক্ষের চাওয়ার মধ্যে আসলে খুব বেশি পার্থক্য ছিল না। কেবল সমস্যা হয়েছে এটিচুডে। কিছু শব্দ চয়নে। নেপথ্যে ছিল ইগোর দ্বন্দ্ব আর এরপরতো একটার পর একটা ঘটনা চেইন রিয়েকশনের মতো ঘটে গেল। ইগো আর প্রতিশোধের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে গেলো পুরো দেশ। এরই অপেক্ষায় ছিল আরেকটা পক্ষ। তারা চায় রেজিমের পরিবর্তন। এসবকিছুরই লাইভ টেলিকাস্ট হচ্ছে ফেসবুকে। আপনারা অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছেন মোবাইল স্ক্রিনের দিকে। আজকাল টিভির চাহিদা কমেছে। মানুষ ইন্টারনেটেই সময় দেয় বেশি। ফেসবুকে আর ইউটিউবে দেয়। নেট বন্ধ থাকায় টিভি চ্যনেলগুলোর পোয়াবারো হয়েছে। তারা বলেছে, ‘এই ফাঁকে আমরা ফিরে পেলাম আমাদের পুরনো দর্শক।’ বাণিজ্যের পরিভাষায় টিআরপি বেড়েছে। টিভির স্ক্রিনে আমরা দেখছি নিহত মানুষগুলোর স্বজন কাঁদছে। ক্ষুব্ধ ছাত্ররা ইট ছুঁড়ছে। পুলিশ রক্তাক্ত হচ্ছে, গুলি ছুঁড়ছে। টিআরপি বাড়ছে। সবাই যাকে চায় সেই টিআরপি। প্রায় দশ বারো বছর আগে দেখা একটা নাটক। নাটকের নায়ক মোশাররফ করিম রেললাইনে সুইসাইড করতে যায়। তাকে বাঁচায় রিচি সোলায়মান। রিচি আর হাসান মাসুদ রেললাইনে গিয়েছিলেন একটা বিজ্ঞাপনের লোকেশন ভিজিট করতে। মোশাররফের এই সুইসাইড করতে যাওয়া দেখে বিজ্ঞাপনী সংস্থার ঊর্ধ্বতন অ্যাক্টিকিউটিভ হাসান মাসুদের মাথায় প্ল্যান আসে যে সে এই সুইসাইডের ঘটনাকে লাইভ টেলিকাস্ট করাবে। এই নিয়ে অফিসে মিটিং হয়। বাদানুবাদ হয়। কিন্তু হাসান মাসুদ ব্যখ্যা করেন যে, এটা একটা দুর্দান্ত বিজ্ঞাপনী আইডিয়া। মানুষটি এমনিতেও সুইসাইড করতো, তারচেয়ে এটাকে একটা প্রোডাক্টিভ কাজে লাগানো যায়। মোশাররফের টাকাপয়সার দরকার, হয়তো তার পরিবারের জন্যই। তাকে দশ লাখ টাকা দেওয়া হবে। এর বিনিময়ে সে সুইসাইডটি করবে অন ক্যামেরা, লাইভ টেলিকাস্টের মাধ্যমে। একজন যুবক আয়োজন করে, জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়ে সুইসাইড করছে এটা জানতে পারলে কিছু চ্যানেল লাইভ টেলিকাস্ট করবে। একটা চ্যানেল করলে আরেকটা চ্যানেল যোগ দেবে। দেশজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়বে। সবাই টিভির সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। সুইসাইডের ঠিক আগে মোশাররফ করিম শুধু হাসান মাসুদের কোম্পানির একটা প্রোডাক্টের নাম বলে যাবে। এটাই হলো ডিল। এই ফাঁকে সারাদেশের মানুষ সেই কোম্পানির প্রোডাক্টের নামটা জেনে যাবে।
এই প্ল্যান রিচি সোলায়মান মানতে পারেনা। সে চাকরি ছেড়ে দেয়। স্ক্রিপ্ট বানানো হয়। রিহার্সেলও হয়। নির্দিষ্ট দিনে মোশাররফ করিম সুইসাইড করতে যায়। টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকরা আসে বুম আর ক্যামেরা নিয়ে। তারা অনুভূতি জানতে চায়। সুইসাইডের কারণ জানতে চায়। নাটকীয় কায়দায় দেশবাসীর উদ্দেশে কিছু বলার আছে কিনা জানতে চায়। কিছু দর্শক মোশাররফ করিমকে তার মোবাইলে ফোন করে। একজন অনুরোধ করে তার প্রেমিকাকে বিয়েতে রাজি করাতে। একজন ভার্সিটির ছাত্র অনুরোধ করে মোশাররফ করিম যেন তাদের প্রফেসরকে বলে পরীক্ষাটা পিছিয়ে দেন। মোশাররফ করিম একে একে তাদের অনুরোধ রক্ষা করে। তার মনে পজিটিভ ভাইব আসে। মানুষের কাজে লাগতে পেরে সে অনুভব করে বেঁচে থাকাটা আসলে মূল্যবান। এই ফাঁকে মোশাররফের সাথে ফোনে কথা হয় রিচি সোলায়মানের। যে কাঁদতে কাঁদতে বলে, সুইসাইড না করে চল আমরা ফুচকা খেতে যাই সংসদ ভবনের পেছনের রাস্তায়। মুহূর্তেই বদলে যায় দৃশ্যপট। রিচির কান্না জড়িত আহবানে মোশাররফ প্রেমে গলে যায়।
একদল উত্তেজনাসক্ত মানুষ, উত্তেজিত টিভি চ্যানেলের নিউজ রিপোর্টাররা হতাশ হয়ে পড়ে। তাদের হতাশার কারণ স্পষ্ট। একটা চূড়ান্ত নাটকীয়তা থেকে বঞ্চিত হয় তাদের দর্শক। হাসান মাসুদের হতাশা আরো বেশি। কারণটিতো বুঝতেই পারছেন। বাংলাদেশের এক শ্রেণির পলিটশিয়ান আজ হাসান মাসুদের ভূমিকায়। কেউ কেউ টিভি চ্যানেলের রিপোর্টারের জায়গায়। কেউ টিভি চ্যানেলের সামনে বসে থাকা দর্শকদের মতো। এত গভীর ইনসাইট আর ইন্টেলেকচুয়াল নাটক বাংলাদেশে কেউ বানাতে পারে, সেটা দেখে আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। মেকিংও ছিল খুব গতিশীল। দুর্দান্ত সংলাপ। পরিচালনা করেছেন মাহফুজ আহমেদ। যাকে আমরা অভিনেতা হিসেবে চিনি। একটাই অসুবিধা। নাটকটার রাইটার আপনাদের অনেকের অপছন্দের মানুষ মুহম্মদ জাফর ইকবাল। লেখক: চিকিৎসক