
ধানে জিন বিকৃতির কৃষি তাত্ত্বিক পরিনাম
ড. একেএম সোবহান
ধান বাংলাদেশের মানুষের প্রধান দানা শস্য। পল্লী অঞ্চলে এখনও ৪৮ শতাংশ মানুষের জীবিকার প্রধান অবলম্বন ধান। দুই তৃতীয়াংশ মানুষের ক্যালোরি সরবরাহের প্রধান উৎস। প্রয়োজনীয় আমিষের সরবরাহ অর্ধেক-ই নিশ্চিত হয় ধান থেকে। কৃষি (জিডিপি)’র অর্ধেক আসে ধানের মাধ্যমে। জাতীয় আয়ের ছয় ভাগের এক ভাগ অর্জিত হয় ধান থেকে। প্রায় এককোটি ত্রিশলক্ষ কৃষি পরিবার ধান উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশে এক কোটি ষোললক্ষ হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ হয়। কৃষি জিডিপির অর্ধেক আসে ধানের মাধ্যমে। আবাদি জমির ৭৫ শতাংশের বেশি জমিতে ধানের আবাদ হয়। বছরে ৩৪ মিলিয়ন টন (তিন কোটি চল্লিশলক্ষ টন) ধান উৎপাদন হয়।
আমরা জানি বাংলাদেশ ধানের আদি উৎপত্তিস্থল। আমরা ১৯৯২ সালে কনভেনশন অন বাইওলজিক্যাল ডাইভারসিটি স্বাক্ষর করেছি। ১৯৯৪ সালে তা অনুস্বাক্ষরও করেছি। এর মাধ্যমে আমরা ধানের স্থানীয় জাত সংরক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। গত শতাব্দীর প্রথম দিকে এদেশে ১৫ হাজার স্থানীয় জাতের ধান ছিল। ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে সবুজ বিপ্লবের হাত ধরে ইরি এবং বাংলাদেশ রাইস রিসার্চ ইনিষ্টিটিউট (ব্রি)’র সহায়তায় উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত প্রবর্তন করা হয়। ১৯৯৮ সালের পর থেকে হাইব্রিড ধানের প্রবর্তন শুরু হয়। চীন, ভারত, ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইন থেকে হাইব্রিড ধানের বীজ আমদানি করা হয়। অবশ্য এখন দেশেও হাইব্রিড ধানের বীজ উৎপাদন হচ্ছে। দেশে বর্তমানে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত ৬৪ টি উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত এবং ১০০ টি হাইব্রিড ধানের প্রচলন থাকলেও বাস্তবে দেখা যায় আমন মৌসুমে বি. আর ১১ এবং বোরো মৌসুমে ব্রি ধান ২৮ এবং ব্রি ধান ২৯ আবাদ হচ্ছে। অর্থাৎ ধানের কৌলিক ব্যাপ্তি সংকীর্ণ হয়ে আসছে। আউশ ধানের আবাদ প্রায় বিলুপ্ত।
মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মত এখন আবার বাংলাদেশের সব চেয়ে জনপ্রিয় ধানের জাত ব্রি ধান ২৯ এর জিন বিকৃতির মাধ্যমে গোল্ডেন রাইস উদ্ভাবন করা হয়েছে। দাবি করা হচ্ছে যে ভুট্টা থেকে জিন নিয়ে ধানে ভিটামিন ‘এ’ সংযোজন করা হয়েছে। উদ্দেশ্য মহত- রাতকানা রোগ উপসম করা হবে। বিষয়টা এত সহজ এবং সরলরৈখিক নয়। এ প্রসঙ্গে চীনের একটি পত্রিকার মন্তব্য উল্লেখ করা ঞযব ঈযরহধ উধরষু (২০১০. ০২. ০৪): “ওঃ রিষষ যধাব ধ াবৎু নরম রসঢ়ধপঃ ড়হ ভড়ড়ফ ংধভবঃু, বহারৎড়হসবহঃধষ ংধভবঃু ধহফ নরড়ষড়মরপধষ ফরাবৎংরঃু.
জিন বিকৃতি দালান কোঠার নকশা পরিবর্তনের মত কোন সহজ বিষয় নয়। ধানের জেনোমে ৫০ হাজারের অধিক জিন রয়েছে। সেখানে বিশেষ কোন গুণসম্পন্ন একটি বা দুটি জিন সংযোজন করেই সেই বিশেষ গুণসহ অন্য সকল গুণের হুবহু প্রতিফলন আশা করা যায় না। বরং হাজার হাজার বছর ধরে প্রকৃতিতে এবং কৃষকের হাতে বাছাই এর ফলে যে সকল গুণের সমন্বয় ঘটেছে তাও আমুল পরিবর্তন হতে পারে। গত দুই দশক ধরে বিভিন্ন দেশে ভুট্টা, তুলা, সয়াবিন, সুগারবিট, টমেটো, ক্যানোলা ইত্যাদির আবাদ হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৩ বছরের ভুট্টার আবাদ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে এ সময় যদি কোন জিএম ফসলের আবাদ না হত তা হলে ফলন বেশী হত।
ভারতে বিটি তুলা আবাদ করে ফসল হানির কারনে কৃষকের আত্মহত্যার বিষয়টি আমাদের সকলেরই জানা। জিএম সয়াবিনের ক্ষেতে আগাছানাশক প্রতিরোধী আগাছার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর্জেনিটিনা এবং ব্রাজিলের সয়াবিন আবাদ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।
তাছাড়া অটিজমের সাথে জিএমও সয়াবিনের প্রত্যক্ষ সম্পর্কের বিষয়টি বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ও এ সমস্যা মারাত্বক আকার ধারণ করেছে।
কৃষি মানবজাতির জন্য প্রকৃতির অমূল্য উপহার। বীজ তার চাবি। কৃষিকে বাঁচাতে হলে জাতের বৈচিত্র্য রক্ষা করতে হবে। জিন বিকৃতির হাত থেকে বীজ রক্ষা করতে হবে। বহুজাতিক আগ্রাসন থেকে প্রাণসম্পদ রক্ষা করতে হবে। কৃষকের বীজ কৃষকের হাতে রাখতে হবে। নতুবা জাতি হিসাবে আমাদের অস্তিত্ত্ব বিপন্ন হবে। আসুন আমরা সকলে মিলে আমাদের প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা করি।
