উপমহাদেশের বিপ্লবের অথরিটি কমরেড চারু মজুমদার
মনজুরুল হক
আজ থেকে ৫২ বছর আগে ১৯৭২ সালের এই দিনে ভারতবর্ষের মুক্তিকামী মানুষের পথপ্রদর্শক, সর্বহারা শ্রেণীর শ্রেষ্ঠ শিক্ষক, সিপিআই(এম-এল) এর প্রতিষ্ঠাতা, কৃষি বিপ্লবের রূপকার, রঙবেরঙের সংশোধনবাদীদের মুখোশ ছিঁড়ে ফেলে সত্যিকার কৃষিবিপ্লব তথা ভারতীয় প্রেক্ষাপটে জনযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি মহান নেতা কমরেড চারু মজুমদের শারীরিক মৃত্যু ঘটে। তাঁকে পুলিশ লকআপে হত্যা করা হয়। সিপিআই (এম-এল) বহুধা বিভক্ত হলেও আজকের দিনে সকল মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাও সেতুং চিন্তানুসারীরা তাঁর শহীদ দিবস পালন করছেন। লাল সেলাম কমরেড। বিপ্লবীর মৃত্যু হয়না। বিপ্লবের মৃত্যু হয় না। নক্সালবাড়ি আর কমরেড চারু মজুমদার অভিন্ন-এই কথার মধ্যেও ফাঁক আছে। নক্সালবাড়ি আর কমরেড চারু মজুমদার এক কিংবা অভিন্ন নয়। চারু মজুমদার একটি চেতনা। নক্সালবাড়ি একটি প্রতীক মাত্র, অপরদিকে কমরেড চারু মজুমদার কাণ্ডারি-পথ প্রদর্শক, শ্রেণি সংগ্রামের মহান শিক্ষক। নক্সালবাড়ির শিক্ষা বলতে চারু মজুমদারের শিক্ষাকেই বুঝতে হবে। চারু মজুমদারকে বাদ দিয়ে, অমান্য করে, কিংবা খণ্ডন করে ‘নক্সালবাড়ি আন্দোলন’ পালন করার অভিসন্ধির মধ্যে স্পষ্ট প্রতারণা রয়েছে। যেটা ভারতে যেমন হয়েছে, এপারে বাংলাদেশেও হয়েছে এবং হচ্ছে।
নক্সালবাড়ির আন্দোলন টুপ করে গাছ থেকে পড়েনি। কয়েকজন বিপ্লবাকাঙ্খী একরোখা মানুষের ঐকান্তিক চেষ্টা, ধনুর্ভঙ্গ পণ থেকে নিঃশর্ত আত্মত্যাগ দিয়ে তিলে তিলে নক্সালবাড়ির কর্ষিত জমিনে মুক্তির বীজ রোপিত হয়েছে। সে ইতিহাস ব্যাপ্ত। এই পরিসরে বর্ণনা অপ্রতুল এবং খণ্ডিত হবে। বাংলাদেশে যারা নকশালপন্থী আদর্শের পার্টি করতেন তারা ‘ক্রসফায়ার’ সহ ত্রিমুখি আক্রমণে পর্যুদস্তু হয়ে প্রায় ছত্রভঙ্গ। নানা ভাগে, নানা ফ্যাকশনে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে এখন আর প্রশাসন বা শাসকশ্রেণিকে চ্যালেঞ্জ করার শক্তি রাখে না। এই অবসরে রঙ বেরঙের চারু মজুমদারপন্থী ঝাঁকের কৈ উজিয়ে এসেছে। তারা আজকে চারু মজুমদারকে যে জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছেন তাতে করে চারু মজুমদারের নামে পূজো-অর্চনা, মিলাদ-কুলখানি, মাওবাদ, চারু মজুমদারের শিক্ষা, সশস্ত্র সংগ্রাম, শ্রেণি সংগ্রাম এমন এক ‘গ্যাঁজানো চোলাই’ হয়ে উঠেছে যেন। যারা এই ফ্যাশনবাজী করছেন তারা চারু মজুমদারের মূল নীতি সশস্ত্র সংগ্রামের পথ থেকে অনেকটাই দূরে সরে গেছেন, অথচ সামাজিক মাধ্যমে বেশ কলার উঁচু করে বলেন ‘আমরা মাওবাদী, চারু মজুমদারপন্থী।’ অথচ এই ‘ক্রসফায়ার’ শাসিত জমানায় তারা প্রশাসন বা পুলিশের চক্ষুশূল হচ্ছে না। অবাক ব্যাপার নয়? যারা চারু মজুমদারের লাইনকে উর্ধ্বে তুলে ধরেন তারাই নক্সালবাড়ি কৃষি বিপ্লবের লাইনকে উর্ধ্বে তুলে ধরবেন। অথচ এখানে তেমনটি ঘটেনি। তারা কেউই চারু মজুমদারকে ‘বিপ্লবের অথোরিটিমনে করেন না। এটা হল স্রষ্টাকে বাদ দিয়ে সৃষ্টির গুণকীর্তন করা। চারু মজুমদারের হত্যাকাণ্ড নিয়ে নিয়ে অসংখ্য বই-পত্তর বেরিয়েছে।
এমনকি দায়িত্বপ্রাপ্ত সাব ইন্সপেক্টর রুণু গুহ নিয়োগীও পরে চারু মজুমদারকে গ্রেপ্তার করার ‘কৃতিত্ব’ নিয়ে ‘সাদা আমি কালো আমি’ নামে বই বার করেছেন। দার্জিলিং মেইল ধরতে যাওয়া ‘ক্যুরিয়ার’ ছেলেটাকে অনেক দিন ধরে ফলো করে শেষে গ্রেপ্তার করেই চারু মজুমদারের সকল তথ্য পায় পুলিশ। আর সেই ক্যুরিয়ারকে ধরার খবর পায় দীপক বিশ্বাসের বিশ্বাসঘতকতায়। রুণুর বইতে বলা হয়েছে ‘এমনিতেই তিনি অসুস্থ্য ছিলেন, তার উপর তার সব শক্তিশালী পার্টি সদস্যরা আমাদের কব্জায় জেনে তিনি মানসিকভাবে একেবারে ভেঙ্গে পড়েছিলেন। তার ওপর পেথিড্রিন ইনজেকশন বন্ধ করে দেওয়া এবং প্রচণ্ড জেরার চাপে তিনি ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে পড়েছিলেন তার ওপর’। এই ‘তার ওপর’ মানে যে তাঁকে লকআপ প্রচণ্ড নির্যাতন করা হয়েছিল সেটাই রুণু নিয়োগী ঠারেঠোরে বোঝাতে চাইলেন। ‘কিপ এলারর্ট। চারু মজুমদারে ইজ ডেড। উই মাস্ট বি অন দ্য অফেনসিভ।’ অয়্যারলেসের মাধ্যমে গোটা পশ্চিম বাংলার থানায় ঘন ঘন মেসেজ ছড়িয়ে যেতে থাকে। গ্রেপ্তার হবার মাত্র বারো দিনের মাথায় মারা গেলেন। ওদের এতটুকু সাহস হলো না তাঁকে রেখে বিচারের প্রহসনটুকু করার। কেন এত ভয়? কড়া পুলিশ প্রহরায় মৃতদেহ দাহ করা হলো বৈদ্যুতিক চুল্লীতে অতি গোপনে। কোন সাংবাদিক, ক্যামেরাম্যানকে পর্যন্ত যেতে দেওয়া হয়নি তাঁর কাছে। পুলিশের কাছে কাদের যেন কঠোর নির্দেশ, কোন প্রশ্ন করা চলবে না।
শুধু সমস্ত মন্ত্রী ও নেতাদের বাড়ীর সামনে গিজ গিজ করছিল পুলিশ আর পুলিশ তাঁর মৃত্যুর পর। ১৯৯৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর অ্যাসোসিয়েশন অব প্রোটেকশন অব ডেমোক্র্যাটিক রাইটস-এর কার্যকরী কমিটির সদস্য সুজাত ভদ্র ও প্রয়াত চারু মজুদারের ছেলে অভিজিৎ মজুমদার কলকাতা হাইকোর্টে একটি মামলা দায়ের করেন (ডব্লু পি নং ১৭১৪১ ডব্লু ১৯৯৮) ভারতীয় সংবিধানের ২২৬ ধারা বলে তারা অভিযোগ করলেন যে ১৯৬৮-১৯৭২ এর মধ্যে রাজ্যের পুলিশ প্রশাসন নকশালবাড়ির সমর্থকদের এবং সেই আন্দোলনের নেতাদের সমস্ত রকম মানবিক অধিকার ও সংবিধানের মৌলিক অধিকার অগ্রাহ্য করে নির্বিচারে হত্যা করেছে। একই সঙ্গে আরও দুটি অধিকারও লঙ্ঘিত হয়েছে [১] ইন্টারন্যাশনাল কনভেন্ট অব সিভিল এন্ড পলিটিক্যাল রাইটস-১৯৬৬ ও [২] ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস ১৯৪৮ (এবং জলার্ক, চারু মজুমদার সংখ্যা-১, ২০০৯) যে মামলার কোনও খবর আজ আর কারও কাছে নেই। নকশালবাড়ি সাম্প্রতিক ভারতবর্ষের ইতিহাসের সর্বশেষ বিভাজন–রেখা। এদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ–সংস্কৃতি এবং ব্যক্তিগত জীবনযাপনও নকশালবাড়ির কৃষক অভ্যুত্থানের আগে যেমনটি ছিল পরে আর তেমনটি থাকেনি। ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতা আজও নকশালপন্থীরা দখল করতে পারেনি এটাও বাস্তবতা। কিন্তু ১৯৬৭তে তরাইয়ের আকাশে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ যে ভারতবর্ষের আবহমানকালের ইতিহাসের এক অভিনব পালাবদলের নির্ঘোষ নিনাদ করেছিল তা আজ অমোচনীয় সত্য এবং শত্রু-মিত্রনির্বিশেষে সকলেই স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। সমাজগবেষকরা আজ নানাভাবে সমীক্ষা করে দেখেছেন ভারতবর্ষের জনজীবনের সর্বক্ষেত্রে নকশালবাড়ির অগ্নিস্ফূলিঙ্গ একেবারে মৌলিক পরিবর্তন এনেছে। এমনকি শাসকশ্রেণীগুলির আদবকায়দাও সে বদলে দিয়েছে। চারু মজুমদার বলেছিলেন ‘বিপ্লবী পার্টি গড়ার প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে গ্রামাঞ্চলে সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তোলা।
এ কাজে হাত না দেওয়া পর্যন্ত বিপ্লব শুধু মুখে স্বীকার করা হোল। সুতরাং চেয়ারম্যানের ভাষায় তাঁরা হলেন, কথায় বিপ্লবী। আমাদের বিপ্লবী পার্টি গড়ে উঠবে কাজে বিপ্লবীদের দ্বারা। তাই পার্টির ভেতরে যে বিপ্লবী শক্তি আছে তার উপর ভরসা করলে আমরা বিপ্লবী পার্টির বাইরে লক্ষ লক্ষ বিপ্লবী নওজোয়ানদের প্রতি। তবেই সত্যিকারের বিপ্লবী পার্টি গড়ে উঠবে এবং সশস্ত্র সংগ্রামের বিপ্লবের ঘাঁটি আমরা তৈরী করতে পারবো। কমরেডস, আমাদের দায়িত্ব অনেক। নকশালবাড়ীর ছোট্ট স্ফূলিঙ্গ সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংগ্রামী জনগণকে উৎসাহিত করে, উৎসাহিত করে বিশ্ব বিপ্লবের নেতা মহান চীন পার্টির নেতাদের, উৎসাহিত করে পৃথিবীর সমস্ত দেশের বিপ্লবী জনতাকে। এক পবিত্রতম আন্তর্জাতিক দায়িত্ব আমাদের মাথায় এবং আমরা এই দায়িত্ব পালন করবোই। মূল্য দিতে হবে অনেক, কিন্তু মূল্য দিতে ভয় পায় না বিপ্লবীরা চেয়ারম্যানের শিক্ষা: আমাদের লড়বার হিম্মত রাখতে হবে-জেতবার হিম্মত রাখতে হবে’। শেষে প্রতি বছর ‘নিয়ম করে’ যা লিখে শেষ করি। পৃথিবীর এযাবতকালের লিখিত ইতিহাসে আর কখনও এমন ঘটনা ঘটেনি। আর কখনও এমন কৃষক অভ্যুত্থান বিস্ফোরিত হয়নি। আর কখনও সেই কৃষক আন্দোলনের দেখানো পথে মার্কসবাদী-লেনিনবাদ বিপ্লবের অগ্নিস্ফূরণ ঘটেনি। আর কখনও এভাবে শহুরে প্রিভিলেজড মধ্যবিত্ত ডি-ক্লাসড হয়ে গ্রামে গিয়ে কৃষকের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেনি। এভাবে ইতিহাসের হাত ধরে এগুতে থাকলে দেখা যাবে পৃথিবীর ইতিহাসের অনেক নতুন উপাদান এই নকশালবাড়ি কৃষক অভ্যুত্থান বা ‘বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ’ থেকে জন্ম নিয়েছে। ভারতবর্ষ তো বটেই, এই গোটা অঞ্চলেই সর্বহারা শ্রেণির বিপ্লব-বিদ্রোহে তাই এই ঐতিহাসিক নকশালবাড়ি কৃষক অভ্যুত্থান এক আলোকবর্তিকা। এক মাইলফলক। আর তার স্রষ্টা কমরেড চারু মজুমদারও উপমহাদেশের বিপ্লবের অথোরিটি হিসাবে ধ্রুব তারার মত জ্বল জ্বল করতে থাকবেন। লেখক ও ফ্রিল্যান্স জার্নালিস্ট। মনজুরুল হক। ২৮ জুলাই, ২০২৪।