বাংলাদেশের রাজনৈতিক গোলক-ধাঁধা!
মিরাজুল ইসলাম
আমরা যারা আক্ষরিক অর্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করি, তারা আওয়ামী শাসনের কার্যক্রম পছন্দ না করলেও ২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলন সমর্থন করেছিলাম। ভেবেছিলাম জামায়াত-শিবির অন্তত নির্মূল হবে। জাতির জনক হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানকে সকল আলোচনা-সমালোচনার ঊর্ধ্বে রাখা এবং স্বাধীনতার অন্যতম ঘোষণাপত্র পাঠকারী হিসেবে জিয়াউর রহমানকে নিয়ে রাজনৈতিক দলাদলি চায় না-এমন একটা প্রজন্ম সংখ্যালঘু হলেও বাংলাদেশে বিদ্যমান আছে এবং থাকবে। সম্ভবত এই ‘কিউট’ প্রজন্মটি চায় দেশ এগিয়ে যাক এবং সব দলের সমান অস্তিত্ব নিয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক আধুনিক বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে বাঁচুক। যদিও যারা জটিল সমীকরণে অভ্যস্ত তাদের কাছে বিষয়টি এতো জলবৎ তলরং নয়। বর্তমানে কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন এবং কীভাবে হাসিনা সরকারের পতন আন্দোলনে রূপ নিলো তা বুঝতে শাহবাগ আন্দোলন আমলে ফিরে যেতে হবে।
নব্বইয়ের গণআন্দোলনের মতো তখনো একধরনের জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছিল। তার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে যাবতীয় আন্দোলনের রূপরেখা ছিল নির্বাচন-কেন্দ্রিক, মানে রাষ্ট্র ক্ষমতায় কে থাকবে না থাকবে তা ঠিক করতে নির্বাচনই ছিল শেষ অস্ত্র। কিন্তু অত্যন্ত কৌতুহল-বেদনা-আশাভঙ্গের সাথে আওয়ামী-বিরোধীরা দেখতে পেলো, ওই শাহবাগের আন্দোলন ছিল মূলত গোলাম আযম গংদের শাস্তি দেবার উপলক্ষ্য করে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষমতা গ্রহণের কৌশল। দিন শেষে ক্ষমতার রাজনীতিই আসল, বাকি সব মেকি। যাকে বলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা এবং আওয়ামী লীগ তার পুরো ফায়দা নিতে পেরেছে। এরপর আমরা দেখলাম খুব দ্রুত বাংলাদেশে ধর্মান্ধতা ছড়িয়ে দিতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হলো, মুক্তিযুদ্ধের বয়ানকে এককভাবে জিম্মি করা হলো, সেই বয়ান প্রতিষ্ঠা করার প্রক্রিয়ায় ফিল্টার সিস্টেমে ছাগু কালচার যুক্ত করে প্রতিষ্ঠিত করা হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করতে হলে তাকে কেবলমাত্র আওয়ামী সমর্থক হতে হবে। বাকি সব ভুয়া। এটা হলো ক্ষমতায় জারী থাকার নটোরিয়াস স্পিরিচ্যুয়াল এক্টিভিটি।
এই ফাঁকে ক্ষমতা হারানোর পর প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মধ্যে যে ব্যাপক হতাশা এবং ক্ষোভ ছিল তাকে পুঁজি করে হাওয়া ভবন কেন্দ্রিক দুর্নীতি জনগণের সামনে সফলভাবে প্রমাণ করার প্রক্রিয়া সচল ও সফল ছিল। সুতরাং পোয়া বারো। এরপর শুরু হলো পুলিশবাহিনীর সহায়তায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে দেদারসে হয়রানি এবং পঙ্গু বানানোর মিশন। সেই শুদ্ধি অভিযানে সবাইকে বোঝানো গেলো বিরোধী দলগুলো কতো খারাপ। জ্বালাও-পোড়াও ছাড়া তারা আন্দোলন করতে পারে না। ভাবখানা এমন, নব্বইয়ের গণআন্দোলন কিংবা ১/১১ আমলে বিএনপির বিপক্ষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনগুলো ছিল মাখনের মতো নরম এবং গোলাপ ফুলের পাপড়ি বিছানো। ২০১৪ সালের একক নির্বাচনে জয়ী হবার পর বিরোধী দল একটু মাথা চাড়া দিলেই নানা ভাবে তাদের দমনের রাজনীতিতে সফল হয়ে আওয়ামী লীগ আরো মরিয়া হয়ে উঠতে থাকলো।
এর মধ্যে জাতি প্রত্যক্ষ করলো আওয়ামী শাসনের শুরুতে পিলখানায় বিডিআর হত্যাযজ্ঞ। তবে যে ভুল তারেক জিয়া গং করেছে সেই একই ভুল তারা করলো না। দেশের সম্পদ আত্মসাৎ তথা টাকা পাচারের নিত্য নতুন পন্থা আবিষ্কৃত হতে থাকলো। বাংলাদেশে ক্ষমতায় আরোহণের মূল চালিকা শক্তি অর্থ-বাণিজ্যÑ এটা একটা শিশুও বোঝে। শেয়ার মার্কেট থেকে শুরু করে যাবতীয় ব্যাংক লুটপাটে নজিরবিহীন ঘটনাবলী শুরু হয়ে গেলো। গত দশ বছরে আনুমানিক এগার লক্ষ কোটি টাকা চোখের সামনে গায়েব হলো, একই সাথে যুদ্ধ জয়ের মতো গনিমতের মাল হিসেবে জামাতের মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো গিলে ফেলা হলো, মুদ্রাস্ফীতি পেট ফুলে ঢোল হলো-কিন্তু কারো কিছু বলার থাকলেও গুম, হয়রানি এবং মিথ্যা মামলার পুরানো কায়দার সাথে যুক্ত করা হলো মিডিয়া ক্যু এবং সোশ্যাল মিডিয়াতে ‘আমি ভালো তুমি খারাপ’ প্রমাণের পাল্টাপাল্টি বাদানুবাদ।
মাঝখানে কট্টর মোল্লাদের সংগঠন হেফাজতে ইসলামকে নিয়ে ন্যাক্কারজনক খেলা অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো। শাপলা চত্বরে তাদের রাজনৈতিক আন্দোলনকে পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে আবার মলম লাগানো দেখলাম। এরপর থেকে শুধুই তাদের তেল মারা। সেই সুযোগে ওয়াজ-মাহফিলে সাঈদীর প্রেতাত্মায় ভর করে দলে দলে ফিরে এলেন কট্টরপন্থী মোল্লারা। সোশ্যাল মিডিয়া দখল করে কতিপয় ওলামা বাংলাদেশকে মরুভূমি বানানোর স্বপ্নে মাতোয়ারা হয়ে উঠলেন। তাতেও আওয়ামী সমর্থকদের আপত্তি কিংবা সমালোচনা নেই। কারণ রাষ্ট্র ক্ষমতার রূহানী শক্তি বাংলাদেশের কোটি কোটি তাওহিদী ইসলামী জনতার মাঝে লুকিয়ে আছে ততদিনে জানা হয়ে গেছে। এরপর পরবর্তী টার্গেট করা হলো সুশীল মিশ্র অনুভূতিসম্পন্ন বুদ্ধিজীবী মহল এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে যারা সরাসরি আওয়ামী রাজনীতি করে না তাদের।
এই শ্রেণি এক বিশাল উপদ্রব। নানাভাবে সরকারকে সমালোচনা করে। ত্যানা প্যাঁচায়। এদের মধ্যে শুরুতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পঁচানো শুরু হলো বিএনপি ঘেঁষা বুদ্ধিজীবীদের। সরকারের গুণগান গাইতে পারেন না কিংবা সমালোচনা করেন এমন লোকজনের আস্তিনের তলায় বিরোধী দলের সাথে সম্পর্ক খুঁজে পেলে তো সোনার সোহাগা। বুদ্ধিজীবী নির্মূলকরণ মিশনে জামায়াতপন্থীদের কখনো দেখা গেছে, কখনো দেখা যায়নি। তারা অনেকে তখন মিশে গেছে আওয়ামী ভিড়ে। যদিও তাদের আবার দেখা মিলেছে মূলত ২০১৮ সালের একতরফা নির্বাচনের পর। নির্বাচন আলোচনা পরে, এখন না। সাদা চোখে দেখলে অবৈধ বনাম অবাধ নির্বাচনের ইস্যু ২০১৪ সালের আগেও এতোটা মোটা দাগে আলোচ্য ছিল না। যদিও সাত্তার পরবর্তী জিয়া সরকার থেকে শুরু করে এরশাদ সরকার পর্যন্ত নির্বাচনগুলো ছিল গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভেতরেও অগণতান্ত্রিক। তার জের ধরে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম স্বৈরাচার উপাধি পেয়েছিলেন জেনারেল এরশাদ।
বুদ্ধিবৃত্তিক বাংলাদেশ ক্রমশ কেন মেরুদণ্ডহীন হলো তা খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, বিভিন্ন উসিলায় অব্যাহতভাবে আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা পুরস্কৃত হতে দেখে একটা বিশাল ‘নিউট্রাল’ বুদ্ধিজীবীপ্রবণ প্রজন্ম লোভী হয়ে উঠলো। মূলত ১৯৭৫ পরবর্তী দীর্ঘ দুই দশক ক্ষমতার বাইরে থাকার কারণে আওয়ামী লীগের মধ্যে যেমন ত্যাগী নেতৃত্ব জোরদার হয়েছিল, তেমনি একবার ক্ষমতায় এলে কিভাবে সুদে আসলে সব উসুল করা যায়-এমন রাজনৈতিক মতাদর্শের হোমওয়ার্ক করাই ছিল। বিশেষ করে এরশাদ এবং বেগম জিয়ার রাজনৈতিক ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে আওয়ামী থিংক-ট্যাংক জানে কাকে কী ওষুধ প্রয়োগ করতে হয়। প্রথমে যুক্তি তর্কে বুঝিয়ে বলা, এতে কাজ না হলে লোভ দেখানো, তাও না হলে ডাইরেক্ট অ্যাকশন। তারই ধারাবাহিকতায় একাধারে বিভিন্ন ইস্যুতে রাজাকার, আস্তিক-নাস্তিক, চেতনা-বিরোধী, আওয়ামী লীগও জামাতকে একসময় সংসদে সাথে চেয়েছিল তা ভুলিয়ে দেবার পাশাপাশি বিএনপি-জামাতি দোস্তালি বারবার বলতে থাকা, আওয়ামী নেতৃত্বের বিপক্ষে অপ্রিয় কথা এবং কাজ করলে দেশদ্রোহী খেতাব ইত্যাদি যাবতীয় বয়ান-ট্যাগের মার্কেট দিন দিন গরম হতে থাকলো। আওয়ামী থিংক ট্যাংকে ১৯৫২ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত পানির রং ছিল নীল আসমানী। বাংলার জনগণের মুক্তি এবং আকাক্সক্ষার স্বপ্নে সেই চিন্তার জলাধার ভর্তি ছিল। ১৯৭১ সালের পর, বিশেষ করে ১৯৭৫ সাল থেকে তারা পরিচিত হতে থাকলো লাশের রাজনীতির সাথে। শোক থেকে শক্তি এবং শক্তি থেকে ক্ষোভ এবং ক্ষোভের জ্বালা থেকে প্রতিহিংসার আগুনে সেই থিংক ট্যাংক এখন দাউদাউ করে জ্বলছে। আওয়ামী নেতৃত্বের থিংক ট্যাংকের রং এখন রক্ত লাল। এক সময়ের আওয়ামী ভালো মানুষগুলো এখন ধর্মীয় বিশ্বাসে যাই হোক, পয়গম্বর মানেন একজনকেই। অথচ তাদের কেউ কেউ সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করেন না। কী অবিশ্বাস্য দর্শন।
বিপরীতে একদা স্বতন্ত্র বিএনপি এখন জামাতের ট্যাগ এবং ঠ্যাক খেতে খেতে কোণঠাসা। তাদের থিংকট্যাংক সাইজে অনেক ছোট এবং তা মূলত আওয়ামী নির্যাতনের শিকারে আহত-নিহত মতাদর্শের মানুষদের নিয়ে তৈরি হওয়া একটা রঙিন জলাধার। আওয়ামী লীগে মনে করে বিএনপি/জামায়াতের এই মাটির কলসী ঢিল মেরে ভেঙে দিলেই সব ঠাণ্ডা। সেই চেষ্টাই চলছে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, রক্তাক্ত জুলাই আন্দোলন দুর্বার করে তোলা এবং তা নৃশংসভাবে দমন করার ঘটনাবলীতে যারা প্রভূত অর্গাজম উপভোগ করছে তার অপর নাম-জিওপলিটিক্স। বাস্তবের একজন ভালো মানুষ আপনি এবং আমি হয়েছি মর্মাহত। এই জিওপলিটিক্স মেলাতে পারলেই যেন একটি দেশের সরকার, পুলিশ, সেনাবাহিনী সব হালাল হয়ে যায়। যেটা সামলাতে পারলে ক্ষমতায় ‘যুগ যুগ জিও’। লেখক ও চিকিৎসক। ২৮ জুলাই ২০২৪।