অর্থনীতির ক্রান্তিকালীন সময়ে বাংলাদেশ
ড. আবু আহমেদ
বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান দুরবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন নন- এমন মানুষ দেশ-বিদেশের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। তবে এ বিষয়ে সরকার কতোটা উদ্বিগ্ন, তা তাদের দৈনন্দিন আচরণ ও অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট তৎপরতা থেকে মোটেও স্পষ্ট নয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকও অর্থনীতির প্রকৃত অবস্থা জনসমক্ষে প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক। এ অবস্থায় কিছুটা মধ্যবর্তী পর্যায়ের তথ্য-উপাত্ত, কিছুটা আঁচ-অনুমান এবং বাকিটা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যান ব্যবহার করে দেশের অর্থনীতির সর্বশেষ পর্যায় সম্পর্কে যা বলা যায় তা হচ্ছে, দেশের অর্থনীতি বর্তমানে এক চরম ক্রান্তিকালীন সময় অতিক্রম করছে।
রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ক্রমশই নিম্নমুখী হয়ে পড়ছে এবং এ ক্ষেত্রের সাম্প্রতিক প্রবণতা ও বিরাজমান পরিস্থিতি দেখে ধারণা করা চলে যে, সামনের দিনগুলোতে তা আরো হ্রাস পাবে। অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি নিরসনে প্রধান ভরসা ছিল রেমিটেন্স। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘটনায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে যে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে, তাতে করে রেমিটেন্স আহরণের ক্ষেত্রেও ইতোমধ্যে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা দিতে শুরু করেছে। গত দশ মাসের মধ্যে গতমাসেই (জুলাই) রেমিটেন্স আহরণের পরিমাণ ছিল সর্বনিম্ন। বিরাজমান পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে উন্নয়ন সহযোগীদের দিক থেকেও নতুন ঋণ অনুমোদন ও অর্থ ছাড়ের পরিমাণ দুই-ই হ্রাস পাচ্ছে এবং আগামী কয়েক মাস ধরে এ ক্ষেত্রে নেতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে বলেই মনে হচ্ছে। তদুপরি নেতিবাচক ধারায় আছে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগও (এফডিআই)। মোটকথা, বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন বস্তুতই এক বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে নিপতিত এবং সেই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ পরিস্থিতি নামতে নামতে কোথায় যেয়ে ঠেকবে, তা নিশ্চিত করা বলা সত্যি কঠিন। আর সে কঠিন অবস্থাকে অধিকতর কঠিন করে তুলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য গোপন করার নীতি। তবে সবমিলিয়ে বলা চলে যে, এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারার কোনো লক্ষ্মণও আদৌ চোখে পড়ছে না।
আপাতত সুদের হার কমার কোনো সম্ভাবনা নেই; বরং তা বাড়ার সম্ভাবনাই সর্বাধিক, যা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) আরো আগে থেকেই চেয়ে আসছিল। দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতিতে আইএমএফ হয়তো কর বৃদ্ধিসহ আরো নতুন শর্ত আরোপ করবে, যা দেশে মূল্যস্ফীতিকে আরো উসকে দেবে এবং এর প্রভাবে বাজারের পণ্যমূল্য পরিস্থিতি কোথায় যেয়ে ঠেকবে, তা বলা খুবই মুশকিল। তার মানে হচ্ছে, নিম্ন ও সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষের জন্য সামনে আরো দুঃসময় অপেক্ষা করছে। আর সরকারের জন্য পরিস্থিতি বিপদজনক হয়ে দাঁড়াবে যখন দেখা যাবে যে, রাজস্ব আদায়ের হার লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক পেছনে পড়ে আছে। আর রাজস্ব আদায় না বাড়লে বাজেট (রাজস্ব ও উন্নয়ন) বাস্তবায়ন সত্যি কঠিন হয়ে পড়বে। আর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডতো স্থবির হবেই।
অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রচণ্ড ঝুঁকি হয়ে দাঁড়ানো এ সমস্যাগুলো হঠাৎ করে বা এমনি এমনি সৃষ্টি হয়নি। এর একটি বড় অংশ সৃষ্টি হয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয় ও আনুকূল্যে সর্বস্তরে দুর্নীতির প্রসার, মুদ্রাপাচার, ব্যাংক ঋণের ইচ্ছাকৃত খেলাপ, শেয়ারবাজার মেনিপুলেশন ইত্যাদির মতো অপতৎপরতার কারণে। আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সূত্রে এখন যে অস্থির পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তার জন্য পুরোপুরিই দায়ী হচ্ছে রাজনৈতিক অদূরদর্শীতা। মানুষের দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভই এখন দ্রোহে রূপ নিয়েছে এবং এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে চাইলে সেটিও তাই রাজনৈতিকভাবেই করতে হবে। মনে রাখতে হবে, যে তিনটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার গত দেড় দশক ধরে ক্ষমতায় রয়েছে, তার প্রতিটি নিয়েই দেশে-বিদেশে নানা প্রশ্ন ও বিতর্ক রয়েছে। ফলে সেসব প্রশ্ন ও বিতর্কের নিষ্পত্তি না হলে বর্তমান অস্থিরতার স্থায়ী ও টেকসই সমাধান সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। আর সেসবের সমাধান নিশ্চিত করা না গেলে দেশের বিদ্যমান নাজুক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সহসাই কোনো উন্নতি হবে বলে মনে করার কোনোই কারণ নেই।
আমি আশাবাদী মানুষ। কিন্তু রাষ্ট্রের পরিচালক, নীতিনির্ধারক ও সিদ্ধান্তগ্রহীতাদের দম্ভ, জেদ ও আত্মম্ভরিতা দেখে মনে হয় না যে, অতি সহজেই তারা তাদের দীর্ঘদিনের এ অভ্যস্ত আচরণ থেকে বেরিয়ে আসতে সম্মত হবেন। বস্তুতই টানেলের শেষ প্রান্তে এখন পর্যন্ত আলোর কোনো ক্ষুদ্র বিন্দুও চোখে পড়ছে না। তারপরও দেশ, রাষ্ট্র ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থের দিকে তাকিয়ে শেষ পর্যন্ত তাদের যদি এতটুকু কোনো সুমতি হয়, তাহলে সেটুকুই অন্তিম ভরসা। লেখক : বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক