ঈদে মা আমাদের বই উপহার দিতেন
আমার জন্ম সিলেটে। কিন্তু আমার বয়স যখন ছয় তখন কুমিল্লা চলে যাই। সেখানে মা-বাবা দুজনেই চাকরি করতেন। দশ বছর বয়স পর্যন্ত আমি কুমিল্লায় ছিলাম। তারপর আবারও সিলেটে চলে আসি। তখন রোজার ঈদ একেবারেই ভিন্ন একটা আবহে পালিত হতো। রোজায় খুব সাদাসিদা সেহরি খেত লোকজন। ইফতারটা ছিল একেবারেই ব্যক্তিগত খাদ্যগ্রহণ।
আগে মানুষ অসম্ভব রকমের সহনশীল ছিল, সে রকমটা এখন আর নেই। ছেলেবেলায় আমরা খেলাধুলা করতাম, রোজা রাখারও চেষ্টা করতাম। অনেক সময় পরিবার থেকে রোজা রাখতে দিত না। কিন্তু বন্ধুরা মিলে রোজা রাখতাম। সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরে যেতাম। খুব সাদামাটা আয়োজনে আমাদের ইফতার করা হতো। তখন বাইরে থেকে ইফতার কেনার কোনো পদ্ধতি ছিল না। আমার এখনো মনে আছে, ইফতারির জন্য বাইরে থেকে শুধু জিলাপি কেনা হতো, বাকি সবকিছু ঘরেই তৈরি হতো মায়ের হাতে। বাড়িতে ইফতারের সঙ্গে খিচুরি হতো, সেটিই ছিল রাতের খাবার।
মা-বাবা এবং শিক্ষকেরা আমাদের সবাইকে শিখাতেন, রোজার মাসে পরিশ্রম করতে হবে দ্বিগুণ এবং খাদ্যগ্রহণ করতে হবে অর্ধেক। এখন তো দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। মানুষ পরিশ্রম করে অর্ধেক আর খাদ্যগ্রহণ করে দ্বিগুণ বা তারও বেশি। তখন পুরো রমজান মাস সত্যিকার অর্থেই একটি সংযমের মাস ছিল। রোজার মাসে আগে মানুষ ব্যাপক পরিমাণে দান-খয়রাত করত। কোনো বাড়িতে কেউ এসে ইফতারের সময় খালি হাতে চলে যাবে এটা কল্পনাই করা যেত না। সবাই সাধ্যমতো গরিব মানুষদের সাহায্য করত।
আমি যখন সিলেটে থাকতাম, আমাদের পাড়ায় প্রচুর হিন্দু লোক বসবাস করত। সেখানে অনেক মনিপুরী সম্প্রদায়ের লোকজনও ছিল। তারাও রমজান মাসকে সম্মান জানাত। মাঝে মধ্যে এরকমও হয়েছে যে, প্রতিবেশীদের কাছ থেকেও ইফতার আসত। প্রতিবেশীরা আমাদের বাড়িতে ইফতার দিয়ে যেত, আমরা তাদের বাড়িতে ইফতার দিতাম। এখন এই ইফতার দেওয়ার চর্চাটা একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। এখন পরিবারগুলো ভয়ানক রকমের স্বার্থপরের মতো ইফতার পালন করে। ইফতারের সময় টেবিলে প্রচুর পরিমাণ খাবার থাকে, যার বেশির ভাগই অপচয় হয়, তখন অপচয়ের কোনো সুযোগই ছিল না।
আগে কাপড় কেনার জন্য দোকানে দোকানে ঘুরার প্রচলনটা ছিল না। আমাদের বন্ধুদের অনেকেই ঈদে কাপড় পেত না। এ প্রসঙ্গে একটা ছোট গল্প খুব মনে পড়ছে। আমার এক বন্ধুর বাবা থাকতেন লন্ডনে। তিনি একবার তার ছেলের জন্য খুব ভাল একটা শার্ট পাঠালেন। আমার বন্ধু ঈদের দিন সকালে ওই শার্টটা পরল কিন্তু এক ঘণ্টার মধ্যে নতুন শার্টটি খুলে পুরনো একটা শার্ট পড়ে সে। কারণ কী ছিল? কারণ আমাদের অনেক বন্ধুরই তখন ঈদের জামা ছিল না। প্রতি ঈদে জামা-কাপড় পাওয়া যেত না। দেখা যেত, এক ঈদে কাপড় নিলে অন্য ঈদে কাপড় নিতাম না। আমাদের বাসায় যেটা হতো, ঈদে মা আমাদের বই উপহার দিতেন। এই চর্চাটা মনে হয় একেবারেই হারিয়ে গেছে। কোনো পরিবার এখন বই দেওয়ার কথা ভাবতেই পারে না। কোনো মা তার সন্তানকে যদি এখন বলে, ঈদে কাউকে জামা-কাপড় দেওয়া হবে না, বই দেওয়া হবে তাহলে আমার মনে হয়, ওই ছেলে বা মেয়েটা বাড়ি থেকে রাগ করে বের হয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের কাছে সেটাই ছিল একটা ওয়েলকাম গিফ্ট। খুব আনন্দের সঙ্গে বইটা আমরা নিতাম এবং সেটা পড়তাম। বন্ধুদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে পড়তাম। এই যে একটা সম্প্রীতির পরিবেশ, এটা এখন আর দেখা যায় না।
পরিচিতি : শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক
মতামত গ্রহণ : সাগর গনি/সম্পাদনা : আশিক রহমান