সংবিধানের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত গণতন্ত্র
এ্যাড. তৈমূর আলম খন্দকার
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নায়ক উননষ্ঠন চার্চিল তার লেখা অ জওউউখঊ ডজঅচচঊউ ওঘঝওউঊ অঘ ঊগওএগঅ বইতে এ দেশ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘এক অদ্ভুত দেশ, অদ্ভুত এখানকার মানুষ। এ দেশে বিশ্বাসঘাতক উমিচাদ, রায় দুর্লভ, জগৎশেঠ, মীরজাফরদের যেমন কোনো অভাব নেই, তেমনি মীর মদন, মোহন লালের মতো প্রকৃত দেশ প্রেমিকদের কোনো ঘাটতি নেই। এখানে কে কখন জাতীয়তাবাদী, কে কখন দেশদ্রোহী, কে কখন মিত্র, কে কখন শক্র তা বুঝা বড় কঠিন। তারপরও আপন ভূবনে প্রতিটি সৃষ্টিশীল প্রকৃত দেশ প্রেমিকেরা বেঁচে থাকেন, বেঁচে আছেন যুগ যুগান্তরে মানুষের হৃদয়ে।’
সংবিধানের দোহাই দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকেই নির্বাচন হবে এই প্রত্যয় বারবার সরকার পক্ষ থেকে ঘোষণা হচ্ছে। এখন প্রশ্ন আসে সংবিধান কি সংশোধনযোগ্য নহে? সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে যে ক্ষমতা বলে সংবিধানের ৫৮খ ধারা সংশোধন করে ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন’ সংযুক্ত করা হয়েছে; সেই একই ক্ষমতাবলে (১৪২ অনুচ্ছেদ) সংবিধান থেকে ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন’ বাতিল করে ক্ষমতাসীনদের অধীনে নির্বাচনি ব্যবস্থা পুনঃবহাল করা হয়েছে। সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা নি¤œরূপ:
‘ক. সংসদের আইন দ্বারা এই সংবিধানের কোনো বিধান সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন বা রহিতকরণের দ্বারা সংশোধিত হইতে পারিবে:
(অ) অনুরূপ সংশোধনীর জন্য আনীত কোনো বিলের সম্পূর্ণ শিরোনামায় এই সংবিধানের কোনো বিধান সংশোধন করা হইবে বলিয়া স্পষ্টরূপে উল্লেখ না থাকিলে বিলটি বিবেচনার জন্য গ্রহণ করা যাইবে না;
(আ) সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে গৃহীত না হইলে অনুরূপ কোনো বিলে সম্মতিদানের জন্য তাহা রাষ্ট্রপতির নিকট উপস্থাপিত হইবে না;
খ. উপরিউক্ত উপায়ে কোনো বিল গৃহীত হইবার পর সম্মতির জন্য রাষ্ট্রপতির নিকট তাহা উপস্থাপিত হইলে উপস্থাপনের সাতদিনের মধ্যে তিনি বিলটিতে সম্মতিদান করিবেন এবং তিনি তাহা করিতে অসমর্থ হইলে উক্ত মেয়াদের অবসানে তিনি বিলটিতে সম্মতিদান করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে।’
১৯৭২ সন থেকে এ পর্যন্ত ১৬ বার বাংলাদেশের সংবিধানকে ক্ষমতাসীনরা সংশোধন/পরিবর্তন করেছে, ফলে সংবিধান কুরআন শরিফ নহে যাহা পরিবর্তন করা যাবে না। জনগণের প্রয়োজনে যদি প্রয়োজন হবে তবে অবশ্যই সংবিধান সংশোধন করা যাবে। পৃথিবীর বহু রাষ্ট্র লিখিত সংবিধান ছাড়াই চলছে, যেমনÑ যুক্তরাষ্ট্র। অতএব সংবিধানের দোহাই দিয়ে নির্বাচনকে নিজ মুঠোতে আবদ্ধ রাখা একটা বাতুলতা মাত্র যা ক্ষমতাসীনদের ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিয়ে যাবে।
বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অ.ঠ. উওঈঊণ বলেছেন, ‘আইনের সার্বভৌমত্ব সব কথা নয়, মানুষ নিয়ে রাষ্ট্র। মানুষ যদি বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, তবে আইন অচল হয়ে পড়ে। আদালত এমন কিছু করতে পারে না, যাতে গণবিদ্রোহ দেখা দিতে পারে। আইনের সার্বভৌমত্বকে মাথানত করতে হয় গণ সার্বভৌমত্বের কাছে। আইনের শেষ ভিত্তি হলো একটা দেশের সর্বসাধারণের সাধারণ সম্মতি’ সংবিধানকে একটা বোঝা বানিয়ে গণতন্ত্রের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাই সংবিধানের যাতাকলে গণতন্ত্র এখন নিষ্পেষিত, যার একমাত্র সমাধান জনমত, জনবিদ্রোহ তথা গণবিস্ফোরণ। (শেষ)
লেখক: কলামিস্ট ও বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা