বাঙালির ইতিহাসের আরেক কলঙ্কিত দিন
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত রিচার্ড ও’ব্রিয়েনের লেখা উইমেন প্রেসিডেন্টস অ্যান্ড প্রাইম মিনিস্টার্স নামের বইটির প্রচ্ছদে উঠে এসেছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ছবি। আর বইটির লেখায় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে তার সংগ্রাম ও অর্জনকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে; তুলে ধরা হয়েছে বাংলার আপামর জনসাধারণের প্রতি তার নিখাঁদ ভালোবাসা-আবেগের কথা। ওই বইটিতে তুলে ধরা বঙ্গবন্ধুকন্যার একটি প্রণিধানযোগ্য বক্তব্যের মধ্যদিয়েই তার সম্পর্কে সাম্যক ধারণা লাভ করা যায়। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশকে যখন আমি দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব, সম্ভবত তখনই আমি বলতে পারব, আমি গর্বিত’। তিনি শুধু বাংলাদেশের নয়, সারাবিশ্বের মানুষের অধিকার আদায়ে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। তাই তো, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান বলেছেন, ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্ব বিশ্বমানবতার জন্য অনন্য এবং প্রয়োজনীয়। তিনি বিশ্বমানবতার কণ্ঠস্বর।’ মহার্ণবের মতো এমন উদার যার হৃদয়, যার চেতনার সঙ্গে মিশে আছে বাঙালির মুক্তি-ক্রমোন্নতি, সেই তাকে তার প্রাণাধিক প্রিয় জনগণের সংস্রব থেকে দূরে সরিয়ে রেখে নিজেদের ক্ষমতার মসনদকে কুক্ষিগত রাখার অলোকসামান্য অভিলাষে লালসার্ত অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিনের সরকার মিথ্যার বেসাতি দিয়ে গড়া সাজানো মামলায় গ্রেফতার করেছিল যেদিন, স্বাভাবিকভাবেই সেদিনটি হয়ে উঠেছিল বাঙালি জাতির ইতিহাসের এক কলঙ্কিত দিন। আজ থেকে ঠিক বছর দশেক আগের সেই দিনটিকে কলঙ্কিত করার দুঃসাহস দেখিয়ে তারা কেবল দেশে অশান্তির আগুনই জ্বালিয়ে দিল না, সেই সঙ্গে নিজেদের পতনের সুড়ঙ্গও তৈরি প্রশস্থ করে ফেলেছিল। অন্যদিকে সেই কলঙ্কিত দিনটিতে শাপে বরের মতো নেতৃত্বের অগ্নিপরীক্ষায় উতরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা মানুষের হৃদয়ে গেড়েছিলেন চিরস্থায়ী আসন। একবিংশ শতাব্দীর সূচনার বছরই বাংলার আকাশে দুর্ভেদ্য অন্ধকার নেমে এসেছিল। প্রলয়মেঘে ঢেকে যায় পুরো বাংলাদেশ। ষাঁড়াষাড়ির বানের মতো অপ্রতিরোধ্যগতিতে হাওয়াভবন কেন্দ্রিক দুর্নীতি আর লুটপাটের ধকলে বাঙালি হয়ে পড়ে দিশেহারা, বীতশ্রদ্ধ। তাই নিজেদের মসনদ হারানোর ভয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দেওয়া নিয়ে খালেদা জিয়ার সরকারের নানা কূটকৌশল আর ছল-চাতুরি শুরু করে দিয়েছিল। গণতন্ত্রের প্রতি অবিশ্বাসী এই গোষ্ঠীর কারসাজিতে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ সাংবিধানিক ধারা রক্ষা না করে নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদে অধিষ্ঠিত হলে দেশে যে চরম বিশৃঙ্খল ও অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তার সুযোগ নিয়ে ওয়ান ইলেভেনের সৃষ্টির মাধ্যেমে মঈনুদ্দিন-ফখরুদ্দিন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নাম নিয়ে এদেশে ক্ষমতাসীন হয়েছিল। আর এর মধ্যে দিয়ে দেশ প্রবেশ করেছিল আরেক অশুভতিথির ভেতরে। এরা দেশে বিরাজনীতিকরণের ধারা চালু করে দিয়েছিল। এদের মদদ দিয়েছিল সোনার পাথর বাটার স্বপ্নে বিভোর তথাকথিত সুশীল সমাজ, যারা তাদের দীর্ঘদিনের লালিত জিঘাংসা চরিতার্থ করতে অযুক্তিসিদ্ধভাবে মাইনাস টু ফর্মূলা দিয়ে ড. ইউনুস বা তৃতীয় শক্তিকে ক্ষমতায় বসাতে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। রথী-মহারথী হয়ে ওঠা এই কথাবাগীশ সুশীল সমাজ স্বর্ণমৃগ পাওয়ার প্রত্যাশায় কথার বাঁধুনি বাঁধার সঙ্গে সঙ্গে কুপ্ররোচনা, কুমন্ত্রণা দিতে লাগল অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে। এদের সম্মিলিত লিপ্সার প্রথম শিকার হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। কেননা তারা জানত, জ্যোতির্ময়ী বঙ্গবন্ধুকন্যাকে বন্দি করা না গেলে তার আলোকছটায় জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে যাবে তাদের অনুচ্চারিত স্বপ্ন। সেই সময় খালেদা জিয়া তার ভোগান্বেষী দুর্নীতির বরপুত্র খেতাবধারী পুত্রদ্বয়সহ চিরতরে সৌদি আরবে চলে যেতে সম্মত হয়েছিল বিধায় তাকে গ্রেফতার করা হয়নি। অবশ্য পরবর্তীতে নানা সমীকরণের কারণে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে গ্রেফতারের প্রায় মাস দুুই পরে খালেদা জিয়াকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল। একটু পেছনের দিকে দৃকপাত করলেই উপলব্ধি হয়, কি নির্মম সুযোগসন্ধানী ছিল তারা! ২০০৭ সালের মার্চ মাসে অসুস্থ পুত্রবধূকে দেখতে বঙ্গবন্ধুকন্যা যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন, ওমনি দস্তুরমাফিক অবৈধ সরকার তাকে দেশে ফিরতে না দেওয়ার জন্য নিঠুর নোংরা খেলায় মেতে উঠেছিল। কিংবদন্তি নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, ‘তার (শেখ হাসিনা) নেতৃত্বের অসাধারণ গুণ হলো নিপীড়িত, বঞ্চিত, দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানো। শেখ হাসিনার মানুষের প্রতি ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছে।’ সেই পরহিতব্রত, দেশের কল্যাণে আত্মোৎসর্গকারী এবং সতত সত্য ন্যায়ের পথে চলা বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা টুকে দিয়েছিল অবৈধ সরকার। ক্ষমতা গ্রহণের মাস তিনেকের মধ্যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গৃহীত একের পর এক পদক্ষেপ তাদের অসৎ উদ্দেশ্যকে বাঙালির কাছে স্পষ্ট প্রতীয়মান করে তুলেছিল। তারা বঙ্গবন্ধুকন্যার বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা দুর্নীতির মামলা দিলেও দেশের মানুষকে তা বিশ্বাস করানো যায়নি, বরং তারাই মুড়ে যায় অবিশ্বাসের চাদরে। ক্ষমতার লোভ মানুষকে কতটুকু নিচে নামাতে পারে, কতা কুচক্রী মিথ্যাবাদী বানাতে পারে সেদিন তার প্রমাণই পেয়েছিল বাঙালি। কিন্তু যার দেহে বইছে জাতির পিতার শোনিতধারা, যিনি কখনো বিন্দুমাত্র অন্যায়ের সঙ্গে আপোস করেননি, তার পক্ষে এই ঘোরতর অন্যায়ে চুপ করে থাকা কী সম্ভব? না। (চলবে-০১)
লেখক: সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
সম্পাদনা: আশিক রহমান