স্থিতিশীলতা ও কর্মসংস্থান সহায়ক প্রবৃদ্ধিমুখি মুদ্রানীতি ঘোষণা
জাফর আহমদ : চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (২০১৭ জুলাই-ডিসেম্বর) স্থিতিশীলতা ও কর্মসংস্থান সহায়ক প্রবৃদ্ধিমুখি মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকাল বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন গভর্নর ফজলে কবির। এ সময় ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহাম্মদ রাহাসান ও এস কে সুর চৌধুরী, বাংলাদেশ ব্যাংকের চেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট উপদেষ্টা আল্লাহ মালিক কাজেমি, প্রধান অর্থনীতিবিদ ফয়সাল আহমেদ, প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মো. আখতারুজ্জামানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
মূল্যস্ফীতি বাড়ার প্রবণতার মধ্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য পূরণের চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে সরকারি-বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমিয়ে অর্থবছরের প্রথম ভাগের জন্য নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করল বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের এই মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ। গত জানুয়ারি-জুন মেয়াদের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হলেও মে পর্যন্ত সময়ে এ খাতে ঋণ বেড়েছে ১৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ।
নতুন মুদ্রানীতিতে সরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১২ দশমিক ১ শতাংশ, যা আগের মুদ্রানীতিতে ১৬ দশমিক ১ শতাংশ ছিল। আর জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের জন্য অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ। জানুয়ারি-জুন মেয়াদের মুদ্রানীতিতে এই লক্ষ্য ছিল ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ।
ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমিয়ে এনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘সংকোচনমূলক’ মুদ্রানীতি দিল কি নাÑ এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে গভর্নর বলেন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশে আটকে রাখার যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে নতুন মুদ্রানীতির মাধ্যমে সেটা সম্ভব।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, দেশের উত্তর-পূর্ব হাওর অঞ্চলে বিগত অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে আকস্মিক বন্যায় ফসলহানির কারণে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতির কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা এখনও বিদ্যমান। তবে প্রতিবেশী ভারতে ভোক্তামূল্যস্ফীতি ২ শতাংশের নিচে নেমে আসায় এবং ২০১৭ সালের শুরু থেকে জ্বালানি তেল ও অন্যান্য মুখ্য পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য নিম্নমুখী বা স্থিতিশীল থাকায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতি পরিমিত রাখা যাবে বলে আশা করা যায়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি) জুন মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৯৪ শতাংশ। আর অর্থবছরের গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বাড়ায় সরকারের ঋণের বোঝা বাড়তে থাকায় এর সুদহার কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন অর্থনীতিবিদরা। এবারের মুদ্রানীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও একই সুপারিশ করেছে। নতুন মুদ্রানীতিতে বলা হয়েছে, অচিরেই সঞ্চয়পত্রগুলোর মুনাফার হার বিদ্যমান বাজার সুদ হারের সঙ্গে অবশ্যই সম্পর্কিত করতে হবে।
সঞ্চয়পত্রের উচ্চ মুনাফার হার সরকারের সুদ ব্যয়ভার বাড়াবে বলে মনে করেন গভর্নর ফজলে কবির। তিনি বলেন, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বন্ড বাজারের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করবে। এর ফলে মুদ্রানীতির কার্যকারিতার জন্য দরকারি সুষ্ঠু ট্রান্সমিশন চ্যানেলের বিকাশও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই অচিরেই সঞ্চয়পত্রগুলোর মুনাফা হার বিদ্যমান বাজার সুদহারের সঙ্গে সম্পর্কিত করতে হবে।
এস কে সুর বলেন, বন্ড মার্কেট নিয়ে আমরা অনেকদিন ধরে কাজ করছি। এক্ষেত্রে সঞ্চয়পত্র অনেকটা বাধার সৃষ্টি করছে ঠিকই। তবে সরকার চাইলে বন্ড ইস্যু করার মাধ্যমে টাকা উত্তোলন করতে পারে। এমনকি ইসলামী ব্যাংকে রিজার্ভ থাকা সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা বন্ড ইস্যু করার মাধ্যমে মেগা প্রকল্পের জন্য সরকার নিতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে নানা কারণে দেশে বর্তমানে ঋণের চাহিদা অনেক কম। ব্যাংক ঋণে সুদের হার কমলেও চাহিদা বাড়ছে না। গুমোট রাজনৈতিক অবস্থা, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট, অবকাঠামো সমস্যা ইত্যাদি কারণে বেসরকারি বিনিয়োগে ধীর গতি চলছে। অন্যদিকে ব্যাংক আমানতের সুদ হার অনেক কমে যাওয়ায় সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে সরকার বাজেট ঘাটতির বড় অংশ পেয়ে যাচ্ছে বলে ব্যাংক থেকে আগের মতো ঋণ নিতে হচ্ছে না। ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ অনেক কমে গেছে। সম্পাদনা : হাসিবুল ফারুক চৌধুরী