স্পোর্টিংলি নিন
প্রভাষ আমিন
বিচ্ছু ফেসবুকারদের নিয়ে আর পারা যাচ্ছে না। কোথাও কোনো আড়াল নেই, কোনো প্রাইভেসি নেই। সবার হাতে হাতে মোবাইল, মানে হাতে হাতে ক্যামেরা। দেশে এখন কোটি কোটি সাংবাদিক। আসল সাংবাদিকদের তবু কিছু নিয়ম-কানুন আছে, মাথার উপর সম্পাদক আছে। কিন্তু ফেসবুক সাংবাদিকরা একেকজন স্বাধীন-সার্বভৌম। যা কিছু চোখে পড়ুক, চোখ দিয়ে দেখে না, ক্যামেরার চোখ দিয়ে দেখে। তারপর ফেসবুকে আপলোড। ব্যস, দায় দায়িত্ব শেষ। এরপর কি না কি ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে যায় দেশে-বিদেশে, ঘরে-বাইরে। আচ্ছা ছেলেবেলায় তো আমরা ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া এক সাথেই পড়েছিলাম। এখন দেখি ব্যাকটেরিয়ার বেইল নাই, চারদিকে ভাইরাসের জয় জয়কার। নিপাহ ভাইরাস, জিকা ভাইরাস তো গোটা বিশ্বে আতঙ্ক ছড়াচ্ছেই; কম্পিউটারে আক্রমণ করে, সেও নাকি ভাইরাস। কোনো ছবি ছড়িয়ে গেলে, সেও নাকি ভাইরাল।
ব্যাকটেরিয়ার জন্য শোক প্রকাশ করে আমরা আবার ভাইরাসে ফিরি। শনিবার বিকালে চালক ইউসুফ ফারাজী ধানমন্ডি ৭/এ এলাকায় ভুল জায়গায় গাড়ি পার্ক করায় সার্জেন্ট মেহেদী তার গাড়ির কাগজপত্র চান। কিন্তু ইউসুফ ফারাজি উল্টো মালিকের দাপট দেখালে মেহেদী তাকে নামিয়ে একটু ধোলাই দেন। এটা ট্রাফিক সার্জেন্টদের রুটিন ওয়ার্ক। প্রতিদিনই দুয়েকটা রিকশাওয়ালা, ভ্যানওয়ালা, ঠ্যালাওয়ালাকে না পেটালে তাদের ভালো ঘুম হয় না। লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরি পেয়েছেন। কারও না কারও উপর তো রাগটা ঝাড়তে হবে। মারার পর ইউসুফ ফারাজী এবং তার গাড়িকে থানায় নিয়ে যান সার্জেন্ট মেহেদী। খবর পেয়ে থানায় ছুটে আসেন মালিক। দ্রুত সমঝোতা করে ফেলেন। সার্জেন্ট মেহেদীকে ১০ হাজার ক্ষতিপূরণ এবং পায়ে ধরে মাফ চেয়ে রেহাই পান মার খাওয়া চালক ইউসুফ ফারাজী। ঘটনা এখানেই মিটে যেতে পারতো। কিন্তু ঐ যে বেকার ফেসবুকার, মানুষের পেছনে লাগা ছাড়া যাদের কোনো কাজ নেই, তারা সেই মারামারির ছবি ফেসবুকে দিয়ে, ভাইরাল করে প্যাচ লাগিয়ে দিয়েছে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, ফারাজীর শার্ট ছেড়া। সার্জেন্ট মেহেদী তাকে মাটিতে ফেলে বুট দিয়ে চেপে ধরে আছে। প্রথম কথা হলো, এত নরম শার্ট পরে ফারাজীর রাস্তায় নামা ঠিক হয়নি। টিনের শার্ট পরে চলাচল করা উচিত ছিল। দ্বিতীয়ত, মেহেদী স্বীকার করেছেন, ফারাজীকে তিনি গ্রেফতার করতে চেয়েছিলেন। গ্রেফতারের কৌশল হিসাবে তাকে মাটিতে ফেলে বুট দিয়ে চেপে ধরে আছেন। ট্রাফিক পুলিশের কৌশল নিয়ে আমাদের সবার এত মাথাব্যথা কেন বুঝি না। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তারাও আছেন, তারাও মূর্খ ফেসবুকারদের সাথে তাল মেলান। ফেসবুকে ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর সার্জেন্ট মেহেদীকে ক্লোজ করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি হয়েছে। দারুণ হইচই। বেচারা শিক্ষানবীশ সার্জেন্ট মেহেদী একটু শিখছিলেন, একটু হাত মকশো করছিলেন। এখন তার সানডে-মানডে ক্লোজ দশা। এই ফেসবুকটা না থাকলে সার্জেন্ট মেহেদীর কিছুই হতো না। উল্টো ১০ হাজার টাকা উপড়ি আয়ে আয়েশ করতে পারতেন। আপনি ভুল জায়গায় গাড়ি পার্ক করবেন, উল্টা রাস্তায় গাড়ি চালাবেন, নিয়মকানুন মানবেন না; তারপর ট্রাফিক সার্জেন্ট আপনাকে মারলেই আপনি হইচই করবেন, এ কেমন দেশ। দেশে কি আইন-কানুন বলে কিছু নেই? আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বুঝি একটু বেশি অধিকার পাবে না?
তবে ভিডিওটি দেখার আমার মনে হয়েছে, সার্জেন্ট মেহেদী নিয়মিত রেসলিং দেখেন। যেভাবে তিনি গাড়িচালক ইউসুফ ফারাজিকে চোখের পলকে মাটিতে ফেলে চেপে ধরলেন, রেসলিংয়ে তা খুব জনপ্রিয় কৌশল। প্রসূনের কল্যাণে আমার মাঝে মাঝে রেসলিং দেখা হয়। নাম জানি না, কিন্তু খুব জনপ্রিয় এক রেসলারের সিগনেচার স্টাইল এটা। রেসলিংয়ে সবসময় সাবধানবাণী থাকে, কেউ যেন বাসায় রেসলিং ট্রাই না করে। সার্জেন্ট মেহেদী সম্ভবত সেখান থেকে কৌশলটা শিখেছেন। কিন্তু প্র্যাকটিস করার সুযোগ পাচ্ছিলেন না। বাসায় ট্রাই করা যাবে না মানলাম, কিন্তু রাস্তায় করা যাবে না, এমন কথা কিন্তু লেখা নেই কোথাও। তাই সুযোগ পেয়েই তিনি ইউসুফ ফারাজির উপর কৌশলটি প্রয়োগ করলেন। মানতেই হবে দারুণ করেছেন। আমি কিন্তু দারুণ ইন্সপায়ার্ড। সার্জেন্ট মেহেদীর মধ্যে আমি একজন উদীয়মান রেসলারের ছায়া দেখতে পাচ্ছি। তাকে ঠিকমত পরিচর্যা করতে পারলে রেসলিং বিশ্বে দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারবেন। আপনারা আবার এরমধ্যে মানবাধিকার-ফানবাধিকার টেনে আনবেন না। জীবনটাকে স্পোর্টিংলি নিন। আর এটা তো প্রায় স্পোর্টস ইভেন্টই।
লেখক : অ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ