মানবতার কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হচ্ছে
পৃথিবী মানবতার দিকে দ্রুততার সহিত এগোচ্ছে, তবে বাস্তবে যা নয় প্রচারে তার চেয়ে অনেক বেশি। মানবতার জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় হচ্ছে মানবাধিকার রক্ষার জন্য। জাতিসংঘ সহ অনেক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন রয়েছে যাদের কাজই হলো, ‘মানবাধিকার’ রক্ষায় যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে তাদের বিভিন্ন খেতাবে পুরুষ্কৃত করা। এ ছাড়াও রয়েছে নোভেল পুরুষ্কার, যার মধ্যে শান্তিতে নোভেল পেয়েছেন মিয়ানমার নেত্রী অং সান সু চি যিনি এখন রক্তপিপাসু নেত্রীতে নিজ চেহারা উম্মোচিত করে নাফ নদীকে রক্তে রঞ্জিত করছেন। অথচ এ মিথ্যাবাদী বলে বেড়াচ্ছে যে, ‘রোহিঙ্গা অধ্য রাখাইন রাজ্যের সবাইকে তার সরকার সুরক্ষা দিচ্ছে।’ একই সঙ্গে সে সত্য ঘটনাকে ভুয়া ও সংবাদ বিকৃত করে প্রচার করছে বলে দাবী করছে।
ইলেকট্রনিক মিডিয়ার পর্দায় ভেসে আসা সংবাদে প্রতিনিয়তই দেখা যাচ্ছে যে, মিয়ানমার বৌদ্ধ ও সেনাবাহিনীর নির্যাতন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সহায় সম্পদ ভিটামাটি সব কিছু ফেলে অবাল বৃদ্ধ বনিতা শিশু বাংলাদেশের দিকে ধাবিত হচ্ছে। শিশু, নারী ও পুরুষদের লাশ নদীতে ভাসছে। মিয়ানমার সরকারের নির্দেশে রোহিঙ্গাদের বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দিয়ে হত্যা করেও ক্ষান্ত হয়নি, গণধর্ষণ অব্যাহত রেখেছে। এতে নিস্তার পাওয়ার জন্য এক কাপড়ে যখন অসহায় মানুষ নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয়ের চেষ্টা করছে তা প্রতিহত করার জন্য বাংলাদেশের সেনাবাহিনী বন্দুক হতে রোহিঙ্গাদের প্রতি তাক করে আছে। বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের গুলিতে রোহিঙ্গার মৃত্যু সংবাদ পাওয়া গেছে। নৌকা ডুবিতে শিশুর লাশ মানুষের মাথায় বহন করার দৃশ্যও দেখা যাচ্ছে। রোহিঙ্গারা যাহাতে মিয়ানমারে ফিরে যেতে না পারে এ জন্য সীমান্তে মাইন পুতে রাখায় বিস্ফোরণে অনেকের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনাগুলি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ভয়াল রাত্রিকে স্বরণ করিয়ে দেয়। ওই দিন রাত্রে পাক হানাদার বাহিনীর নির্মম নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি নর-নারী বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। ভারতের আগ্রাসাী ভূমিকা নিয়ে অনেক বির্তক থাকা স্বত্বেও আমি তৎসময়ে ভারতের ভূমিকা বিশেষ করে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে কৃতজ্ঞতা জানাই। সে দিন যদি ভারত বাংলাদেশের এক কোটি অসহায় মানুষকে আশ্রয় না দিতো তবে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস হয়তো ভিন্নতর হতে পারত। কিন্তু ভারত সে দিন মানবতা দেখিয়েছে, শরণার্থী বাংলাদেশিকে আশ্রয় দিয়েছে, খাদ্য দিয়ে মানবতাকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছে। অথচ রোহিঙ্গাদের প্রশ্নে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা হয়েছে উল্টো। অনুমান করা যাচ্ছে যে, ১৯৭১ সালের সেই ভয়াল দিনগুলোকে বাংলাদেশ সরকার স্মৃতি থেকে মূছে ফেলেছে। নতুবা জীবন রক্ষার্থে আশ্রয়ের জন্য আসা রোহিঙ্গাদের প্রতি বাংলাদেশের তাক করা বন্দুকের নলের দৃশ্য দেখে মাথা হেট হয়ে যায়, যখন এ দৃশ্য দেখি, তখন নিজ মনে নিজেকে ধিক্কার দিই এ ভেবে যে, শুধু মাত্র মুসলমান হওয়ার কারণেই নির্যাতিত হয়ে ৯২% মুসলমানদের রাষ্ট্রে কি তাদের জন্য এতটুকু আশ্রয়ের স্থান হবে না? রোহিঙ্গারা মুসলমান এবং বাংলাদেশ ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হওয়ার কারণেই কি আমাদের বন্দুকের নল রোহিঙ্গাদের প্রতি তাক করে থাকে? বিষয়টি লজ্জা জনক এ কারণে যে, আমাদের সংবিধান মানবজাতির প্রগতিশীল আশা আখাঙ্কার সহিত সংগতি রক্ষা করে আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগীতার ক্ষেত্রে পূর্ণ ভূমিকা পালনের দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে।
বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে যে, ‘আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে। আমরা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করিতেছি যে, আমরা যাহাতে স্বাধীন সত্তার সমৃদ্ধি লাভ করিতে পারি এবং মানবজাতির প্রগতিশীল আশা-আকাঙ্খার সহিত সঙ্গতি রক্ষা করিয়া আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে পূর্ণ ভূমিকা পালন করিতে পারি, সেই জন্য বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিস্বরূপ এই সংবিধানের প্রাধান্য অক্ষুন্ন রাখা এবং ইহার রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধান আমাদের পবিত্র কর্তব্য। এতদ্বারা আমাদের এই গণপরিষদে, অদ্য তের শত ঊনআশী বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসের আঠার তারিখ, মোতাবেক ঊনিশ শত বাহাত্তর খ্রীষ্টাব্দের নভেম্বর মাসের চার তারিখে, আমরা এই সংবিধান রচনা ও বিধিবদ্ধ করিয়া সমবেতভাবে গ্রহণ করিলাম।’ সংবিধানের ‘প্রস্তাবনায়” উপোরক্ত কথাগুলি উল্লেখ করেই সংবিধান প্রনেতারা স্বাক্ষর করেছেন।
বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় তৃতীয় প্যারায় উক্ত ঘোষনা অনুযায়ী পৃথিবীর সকল নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো সহ আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে পূর্ণ ভূমিকা পালন না করলে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সংবিধানকে অসম্মান ও লঙ্গন করা হবে। বাংলাদেশ সরকার কি তাই করছে?
পৃথিবীতে ৫৬টি মুসলিম প্রধান রাষ্ট্র রয়েছে যাদের মধ্যে ইন্দোনেশিয়া, মালোশিয়া, ইরান এবং তুরষ্ক ব্যতীত কোন মুসলিম রাষ্ট্র রোহিঙ্গা প্রশ্নে এগিয়ে আসে নাই। যে সকল রাষ্ট্র নিপীড়িত মানুষের পক্ষে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে তাদের প্রতি রইল কৃতজ্ঞা। যারা এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ায়নি তাদের জন্য থাকবে ধিক্কার। জাতিসংঙ্গের নিরাপত্তা পরিষদের রোহিঙ্গা বিষয়টি উপস্থাপনে চীন ভেটো প্রদান করেছে। কারণ চীন ও মিয়ানমার উভয়ই বৌদ্ধ প্রধান রাষ্ট্র। শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণে চীন একটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হওয়া স্বত্বেও মিয়ানমার এই অমানবিক বিষয়টিকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিল। অথচ মুসলমান রাষ্ট্রের ঘুম ভাঙ্গছে না। তারা পেট্রো ডলার পেয়ে আমোদ প্রমোদে ব্যস্ত। তারা সৌখিন জীবন যাপনের জন্য সমুদ্রে ভিতরে বিলাশ বহুল বালাখানা তৈয়ার করে। অথচ রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্যাতন প্রতিরোধে তারা উদাসীন। ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, রোহিঙ্গাদের মূল শিকড় সৌদি আরবে। সৌদি থেকে জাহাজযোগে তারা মিয়ানমারে আসে। সাগরে ঝড়ের কবলে তাদের জাহাজ ডুবে গেলে ‘রহম রহম’ বলে তারা চিৎকার করলে, সে থেকেই তারা রোহিঙ্গা নামে পরিচিতি লাভ করে। প্রকৃত পক্ষে তারা মুসলমান এবং মুসলমান হওয়াটাই তাদের একমাত্র অপরাধ।
গোটা বিশ্ব এখন মুসলমানদের প্রতিপক্ষ। মুসলমানদের জঙ্গি বানানো হয়েছে। বিশ্বে অশান্তির জন্য মুসলমানরাই দায়ী ইহুদি নাছারাদের প্রচার প্রপাাগান্ডায় এটাই প্রকাশ পায়। তাছাড়া এ বিষয়ে মুসলিম বিরোধী একটি ফান্ড রয়েছে যার পৃষ্ঠপোষক অমুসলিম রাষ্ট্র এবং অবচেতন মনে ভিন্ন পন্থায় পৃথিবীর মহাশক্তিকে খুশি রাখার জন্য মুসলিম নিধন তহবিলে মুসলিম প্রধান রাষ্ট্রগুলোও শরিকানা দিয়ে যাচ্ছে, প্রকাশ্যে বা গোপনে।
মিয়ানমারে এখন যা চলছে তা হলো গণহত্যা এবং সাম্প্রদায়িক গণহত্যা। পাকিস্তান যে ভাবে গণহত্যা করেছিল, তারই পূনরাবৃত্তি হচ্ছে সেখানে। অং সান সু চি শান্তি পুরুষ্কারের কোনো মর্যাদা তো দেননিই বরং এটাকে কুলষিত করেছেন।
লেখক: কলামিষ্ট ও বিএনপি’র চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা
সম্পাদনা: আশিক রহমান