চাল নিয়ে চালবাজি বন্ধ হোক
ওয়াসিম ফারুক
বাংলাদেশ একটি কঠিন সময় পার করছে। ভারত থেকে আসা পানিতে দেশের অর্ধেকেরও বেশি অঞ্চল তলিয়ে ছিল বেশ কিছুদিন। সে পানি না কমতেই মিয়ানমার থেকে নেমে এসেছে সে দেশের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢল, যার সংখ্যা আনুমানিক পাঁচ লাখ। সে দেশের সরকারি বাহিনী ও বৌদ্ধ মৌলবাদীদের দ্বারা গণহত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে নিজেদের ভিটা-মাটি ছেড়ে জীবন বাঁচাতে শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নিয়েছে আমাদের দেশে। আমরা বাংলাদেশিরা মানবিক, তাই মানবতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছি রোহিঙ্গাদের জন্য। দেশের সবাই যখন রোহিঙ্গাদের নিয়ে ব্যস্ত ঠিক এমন সময় আমাদের চালের বাজারে হঠাৎ করেই আগুন লেগে যায়। গরীবের মোটা চালের বাজার দাম পঞ্চাশ টাকা পার হয়েছে আর মধ্যবিত্তের চিকন চাল সত্তর ছাড়িয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন, চালের বাজারে আগুন লাগালো কারা? প্রতি বছরই আমাদের দেশে ভাদ্র-আশ্বিন মাসে চালের বাজার কিছুটা লাগামহীন হয়ে পরে। বোরো ও ইরি ধান বলে পরিচিত যে সকল ধান আছে তা সাধারণত আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসের শেষ নাগাদ কৃষকের গোলা থেকে চলে আসে চালকলের মালিক কিংবা আড়তদারদের গুদামে। মিল মালিক ও আড়তদারেরা অতি মুনাফার লোভে তাদের মজুদ করা চাল বাজারে বিক্রি না করে, অতি মুনাফার লোভে অবৈধ ভাবে মজুদ করে রাখেন, এতে বাজারে চালের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেন এক শ্রেণির অবৈধ ব্যবসায়ী। অবশ্য এর জন্য আমাদের দেশে নোংরা রাজনীতিও কম দায়ী না। কারণ, আমাদের দেশের প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা কোনো না কোনো প্রভাবশালী রাজনীতিক দলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত আর এই রাজনৈতিক সম্পৃক্ততাই অবৈধ ব্যবসায়ীদের অবৈধ ব্যবসার অন্যতম হাতিয়ার। এর সঙ্গে আছে একে অপরের প্রতি দোষারূপের প্রবণতা, যেমন চালের বাজারের কথাই বলি, দাম বাড়ার জন্য খুচরা ব্যবসায়ীরা দোষ চাপাচ্ছেন পাইকারী ব্যবসায়ীদের আবার পাইকারী ব্যবসায়ীরা দোষ দিচ্ছেন মিল মালিকদের আর মিল মালিকরা বন্যা খরা বৃষ্টি কত না অযুহাত আর সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মিডিয়ায় হুমকি ধামকি পর্যন্তই শেষ। সব শেষে সব কিছুরই দায় ভার পরে দেশের সাধারণ মানুষের উপর।
বেশ কয়েক বছর যাবৎই আমাদের সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে আমাদের দেশ নাকি খাদ্যে স্বয়ংস¤পূর্ণ। এর মাঝে দেখলাম বিদেশে ও চাল রফতানি করলো সরকার। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন একটি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশে হুট করে কীভাবে খাদ্যের অর্থাৎ চালের সংকট দেখা দেয়? যে দেশ মাত্র কিছু দিন আগে চাল রফতানি করলো, সে দেশে কে-কেনই বা আশে-পাশের দেশ থেকে লাখ লাখ টন চাল আমদানি করতে হচ্ছে? চালের বাজারের আজ যে নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থা এর জন্য সরকার ব্যবসায়ীদের কাধে দোষ চাপিয়ে নিজেরা দায় মুক্তি পেতে চাচ্ছে। সরকারের কর্তাব্যক্তিরা কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছিল? তাদের কাছে কি কোনো গোয়েন্দা রিপোর্ট ছিল না যে ব্যবসায়ীদের একটি চক্র চালের বাজারকে অস্থির করতে পারে? আমাদের বর্তমান খাদ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও কিন্তু অভিযোগের অন্ত নেই। এর আগে আমরা দেখেছি ব্রাজিল থেকে পঁচা গম আমদানির পর সারা দেশে এ নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। এবার আবার ভিয়েতনামসহ অন্যান্য দেশ থেকে নাকি আতপ চাল আমদানি করতে যাচ্ছে সরকার ।
আতপ চালের আমাদের দেশে কোনো চাহিদা নেই বললেই চলে। আতপ চাল কারও পছন্দ নয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন কার পছন্দে সরকার আতপ চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? প্রতিদিনই সরকারে কর্তাব্যক্তির মুখ থেকে শুনতে পাই চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে চলে আসছে, বাস্তবে বাজার পরস্থিতি পুরোপুরি তার উল্টোটাই দেখছি। সরকার বেগতি হয়ে শেষ পর্যন্ত চাল কিনতে ছুটে গেছেন বর্তমান সময়ে মানবতার সবচেয়ে বড় শত্রু মিয়ানমারের কাছে ।
চালের এই লাগামহীন অবস্থায় দেশের মানুষ আজ দিশেহারা। তাই সরকারসহ চাল ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে আজ ভাবতে হবে দেশের সাধারণ মানুষের কথা। ব্যবসায়ীদের উচিত হবে না অতি মুনাফার লোভে দেশের মানুষের সঙ্গে ছিনিমিনি খেলা। সরকারের করণীয় হবে ব্যবসায়ীদের পাশে নিয়ে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
লেখক: লেখক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: মোহাম্মদ আবদুল অদুদ