মানুষের প্রতি মানুষের অধিকার
মুমিন পরস্পর একটি অঙ্গ, অভিন্ন শরীর। এক মুমিন কষ্ট পেলে অন্যজন ব্যথায় কুঁকড়ে যায়। বিপদাপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। কেউ অনাহারে ভুগলে বা অনাদৃত হলে অপর মুমিন বসে থাকে না। শত কষ্টের মাঝেও আহার যুগিয়ে ও সেবা করে হাসি ফুটায় তার মুখে। সাক্ষাতে অপূর্ব সম্ভাষণের সঙ্গে জড়িয়ে নেয় একে অপরকে। ভালোবাসার আর্দ্রতায় সিক্ত হয়ে অর্জন করে নেয় সোয়াবের ভা-ার। একজন অপরজনকে দয়া, ভালোবাসা, প্রীতি, সৌহার্দ্য দিয়ে আপন করে। ভালোবাসার বন্ধনকে করে নেয় আরো জোড়ালো। সে ভালোবাসায় সমজের মানুষে মানুষে সৃষ্টি হয় অপূর্ব মেলবন্ধন। এমন অনন্য ও মধুবন্ধন চিত্রে যেনো ফুটে ওঠে রাসুলুল্লাহ (স.) এর অমেয় বাণী ‘সকল মুমিন একটি অঙ্গের ন্যায়’ (মুসলিম :২৫৮৬)।
মহানবি হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন মানবতার মূর্তপ্রতীক। জাহিলিয়াতের কালো চাদরে আবৃত আরব সমাজকে আলোকিত করেছিলেন দয়া, মানবতা ও প্রীতি-সৌহার্দ্যরে মাধ্যমে। নবুয়তের পূর্বেই ভালোবাসা দিয়ে মন কেড়েছিলেন সবার। মানবসেবায় স্থাপন করেছিলেন অনন্য নজির। ভালোবাসর ফুল ফুটিয়েছিলেন আরবের মরুসমাজে। নবুওয়ত লাভের প্রাক্কালে মদিনায় ‘হিলফুল ফুজুল’ নামক সংস্থা গড়েছিলেন। সেখানে কয়েকজন সাহাবাকে নিয়ে তিনি এ মর্মে অঙ্গিকারাবদ্ধ হোন, আমরা নিঃস্ব ও অসহায় দুর্গতদের সেবা করবো। অত্যাচারীকে প্রাণপণে বাধা দেবো, দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করবো এবং বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপনে সচেষ্ট হবো। (বিশ্বনবী : ৫৭)
ধনীরা যেনো গরীবদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করে ও বদান্যতা দেখায়, তা উল্লেখ করে আল্লাহ তায়ালা বলেন, আর যাদের ধন-সম্পদে রয়েছে তাদের সে সম্পদ থেকে নির্ধারিত হক, যাঞ্চাকারী ও বঞ্চিতের। (সুরা মাআরিজ, : ২৪-২৫) এক হাদিসে এসেছে, বিধবা ও অসহায়কে সাহায্যকারী ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীর সমতুল্য। (বুখারি : ৬০০৭)
কেউ অভুক্ত বা অসুস্থ হলে নবিজী (সা.) পেরেশান হয়ে পড়তেন। তিনি নিজে তো সাহায্য করতেনই, অপরকেও নির্দেশ দিতেন সাহায্য করার। এ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, অসুস্থ লোকের সেবা করো, ক্ষুধার্তকে অন্ন দাও এবং বন্দিকে মুক্ত করো। (বুখারি : ৫৬৪৯)
এক মুমিনের কাছ থেকে অপর মুমিন কী কী অধিকার লাভ করবে, সে প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, এক মুসলমানের ওপর অন্য মুসলমানের ছয়টি হক রয়েছে। জিজ্ঞেস করা হলো, সেগুলো কী হে আল্লাহর রাসুল? তিনি বললেন, ১. তুমি যখন অপর মুসলমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে, তাকে সালাম দেবে ২. সে যখন তোমাকে নিমন্ত্রণ করবে তা গ্রহণ করবে ৩. সে যখন তোমার মঙ্গল কামনা করবে, তুমিও তার মঙ্গল কামনা করবে ৪. যখন সে হাঁচি দিয়ে আলহামদুলিল্লাহ বলবে, তখন তুমি ইয়ারহামুকাল্লাহ (আল্লাহ তোমার প্রতি রহমত করুন) বলবে ৫. যখন সে অসুস্থ হবে তাকে, দেখতে যাবে ৬. এবং যখন সে মারা যাবে, তখন তার জানাজায় অংশগ্রহণ করবে। (মুসলিম : ৫৭৭৮)
এসব বাণীকে কেন্দ্র করে ভালোবাসার ফুল ফুটেছিলো সাহাবায়ে কেরাম (রা.) এর মাঝে। একজন বিপদে আক্রান্ত হলে অন্যজন বাড়িয়ে দিয়েছেন সাহায্যের হাত। হিজরতের ঘটনা এর একটি অনন্য উদাহরণ। আনসার সাহাবিরা যেভাবে মুহাজির সাহাবিদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন, ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে এর নজির বিরল। তাবেই, তাবে তাবেইন ও পূর্ববর্তী বুজুর্গানে দ্বীনের ইতিহাস চিত্রেও এক মুমিনের প্রতি অপর মুমিনের মানবতা ও সৌহার্দ্যরে অনন্য নজির দেখতে পাই। তারা গড়েছিলেন ভালোবাসাময় পৃথিবী। মানুষের প্রতি সেবাযতœ ও মানবতা দিয়ে স্থাপন করেছিলেন ইনসাফপূর্ণ এক সুন্দর পৃথিবী। পূর্ববর্তী মুসলিম শাসকদের মাঝেও রয়েছে মানবতা ও ভ্রাতৃত্বে বিরল নজির। কোথাও কোনো মজলুম নির্যাতিত হলে ঝাঁপিয়ে পড়ে রক্ষা করেছেন শত্রুদের কবল থেকে। ইতিহাসের পাতায় হজ্জাজ বিন ইউসুফের মজলুম নারীকে শত্রুদের হাত থেকে উদ্ধারের অবিস্বরণীয় ঘটনা লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে। দেবলের একজন মজলুম নারীর চিঠিতে কেঁপে উঠেছিলো তার বুক। জামাতা মুহাম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে বাহিনী পাঠিয়ে জয় করে নেন ভারতবর্ষের একাংশ।
আব্বাসি খলিফা মুতাসিম বিল্লাহ পানি পান করাবস্থায় যখন তার কাছে রোমান সীমান্তে এক মজলুম নারীর আর্তনাদের সংবাদ পৌঁছুলো, তখন তিনি পানির গ্লাস ছুড়ে ফেলে তখনি শত্রুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। পূর্ববর্তী বুজুর্গানে দীনের হাজারো উদাহরণ রয়েছে মজলুমকে সাহায্য করার, অসহায় ও দুস্থদের সেবা করার, অভুক্তকে খাবার দেয়ার। আমরা তাদের উত্তরসূরি। তাই তাদের পদাঙ্ক আমাদেরও অনুসরণ করতে হবে। আমাদের উচিৎ আহার, বস্ত্র ও নগদ টাকাপয়সা দিয়ে দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানো। তাহলেই আমরা হবো রাসুলুল্লাহ (সা.) এর প্রকৃত উম্মত।
ইউপি, ভারত।