বিশ্ব মুসলিম আজ নির্যাতিত কেন?
গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির
কালক্রমে মুসলমানদের মাঝে ইসলামি আদর্শ, ইসলামি ভ্রাতৃত্ব, ইসলামি ঐক্য, ঈমানী শক্তি, আধ্যাত্মিক শক্তিমান যোগ্য নেতা ও যোগ্য নেতৃত্বের অভাব দেখা দেয়, ফলে তারা আত্মকলহ ও স্বজাতিয় ভ্রাতৃঘাতীতে নিমগ্ন হয়ে পড়ে। ইসলামি আদর্শ, ঈমান আকীদা তাদের মধ্য থেকে লোপ পেতে থাকে। তাদের সমরশক্তি বৃদ্ধি পরিবর্তে দুর্বল হতে থাকে। এমনি করে রিসালাতের সূর্য যাদের আলো বিকিরণ করেছিল তারাই পুনরায় অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। আজ গোটা পৃথিবী অমুসলিমদের জ্ঞান-বিজ্ঞান, মানব সেবা ও সমর শক্তির নীচে মাথানত করে দিয়েছে।
কুরআনের প্রথম বানী ছিল জ্ঞান অর্জনের। রাসূল (সা.) এর বানী ছিল- জ্ঞান হিকমত (বিজ্ঞান) অর্জনের। মুসলমানরা তা বর্জন করেছে। অমুসলিমরা তা গ্রহণ করেছে। ফলে জ্ঞান বিজ্ঞানে আজকে অমুসলিমরা এগিয়ে। আজ মুসলমান তাদের নিকট থেকে জ্ঞান আহরণ করছে এবং তাদের কাছেই জ্ঞান-বিজ্ঞান ভিক্ষা মাগছে। আজকে মুসলমান ভ্রাতৃঘাতীতে নিজেরাই নিজেদের কুরবানী দিচ্ছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান আহরণের পরিবর্তে মুর্খতা ও অন্ধত্বকেই আকড়িয়ে ধরছে। নিজের দেশ রক্ষার জন্য ভাড়াটিয়া অমুসলিম ইসলাম বিধ্বংসী বাহিনী রাখছে। আর সামান্য বজ্রপাতের আওয়াজে দেশ থেকে পলায়নের রাস্তা খুঁজে বেদিশা হয়ে পড়ছে। দেশ প্রেমের পরিবর্তে জান প্রেমই গুরুত্ব হয়ে পড়ছে। আর সোনালী যুগের মুসলমানদের মধ্যে যোগ্য ও বলিষ্ঠ নেতার নেতৃত্বে ছিল। নেতার প্রতি আনুগত্য ও ছিল। কালে কালে মুসলমানরা যোগ্য ও বলিষ্ঠ নেতার নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে।
আজ মুসলমান জাতি নেতাহীন। এছাড়া তাদের মাঝে নেতৃত্বে আসন নিয়েও স্ববিরোধী লড়াই চলছে। আজকের পৃথিবীতে যেখানে যোগ্য ও বলিষ্ঠ নেতার নেতৃত্বে রয়েছে। সেখানে মুসলমান জাতি মাথা উচু করে রয়েছে। ফলে তারা মুসলিমদের সমর শক্তির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেরা আধুনিক সমরাস্ত্রের শক্তিতে শক্তিমান হয়ে টেক্কা দিয়ে চলছে। মুসলমান অপরাজয় জাতি। পরাজয়ের গ্লানি এরা মাথা পেতে নিতে জানে না। এ জাতি সহাস্য বদনে আপন জান কুরবান দিতে জানে, তবু বিজাতির গোলামী মাথা পেতে নিতে জানে না। আজো পৃথিবীতে কোনো বিজাতি মুসলমানদের বশ্যতা স্বীকার করাতে পারেনি। তাই তারা তাদের আওতাধীন দেশের মুসলমানদের পাইকারী ভাবে গণহত্যা, নির্যাতন ও নিষ্পেষণ করে দেশ থেকে বিতাড়িত করে দুর্বল ও নির্মূল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাতেও তারা মুসলমানদের বশ্যতায় আনতে পারছে না। অপর দিকে যে মুসলিম জাতি একদিন অমুসলিমদের জান মালের দায় দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল। আজকে অমুসলিমরা মুসলমানের জান-মালের দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করছে না। আজকে ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার মুসলিম দেশগুলো অমুসলিমদের সেবাধর্মী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। অমুসলিমরা মুসলিমদের আত্মকলহ মীমাংসার সালিস হিসাবে কাজ করে যাচ্ছে। মুসলমানরা ইসলামি আদর্শ ও রাসূল (সা.) এর অনুসরনের পরিবর্তে ইসলাম ও রাসূল এর আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়ে নিজেদের খুশিমতো জীবনতরী চালাচ্ছে। আজো মুসলমান জাতি ঈমানী বলে বলিয়ান হয়ে রাসূল (সা.) এর আদর্শে উজ্জীবিত হলে এবং মদীনার আনসারদের ভ্রাতৃত্বে আবদ্ধ হয়ে অধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হলে গোটা পৃথিবী তাদের কাছে মাথানত করবে। মুসলমানদের নেতৃত্বের বড় গুণ আধ্যাত্বিক শক্তি। আধ্যাত্বিক শক্তিমান নেতার নেতৃত্বেই পুনরায় গোটা পৃথিবী জয় করা সম্ভব। শুধুমাত্র সমরশক্তিই মুসলিম শক্তি নয়, অমুসলিমরা মুসলমানের আধ্যাত্মিক শক্তির কাছেই মাথানত করে। নবী রাসূলসহ আউলিয়ায়ে কেরাম ও বিগত মুসলিম মোজাহিদদের মাঝে আধ্যাত্মিক শক্তি ছিল বলেই বিনা যুদ্ধেই অমুসলিমরা মুসলমানদের কাছে মাথানত করে দিয়েছে। ইসলামি আদর্শ, সমর শক্তি, ঈমানী শক্তি ও আধ্যাত্বিক শক্তি মিলেই মুসলমানদের সামগ্রিক শক্তি, এই শক্তির প্রতিলফলন ঘটাতে হবে।
নবী করিম (সা.) মুসলিম উম্মার আর্বিভাব ঘটেছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম জাতিরূপে। মুসলিমরা শ্রেষ্ঠত্বের আসন সংরক্ষিত রেখেছিল খোলাফায়ে রাশেদীনের শাসন কালেও। সব কিছুর সঙ্গে সঙ্গে আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে ন্যায়প্রতিষ্ঠা ছিল মুসলমানদের অনন্যকৃতিত্ব। মুসলিম ভূ-খ-ে ন্যায়পরায়নতার সুবাতাস মানুষের জীবনকে ¯িœগ্ধ করে তুলছিল। পাশ্ববর্তী অমুসলিম দেশগুলোর মানুষেরা এই ¯িœগ্ধতার পরশ পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকত। ন্যায়ের প্রতি এই অনুরাগই মুসলিম উম্মাহকে বিশ্ব সমাজের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছিল। অতীতের মুসলমানরা ছিল শক্তিধর। জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় তাদের স্থান ছিল সকলের উর্দ্ধে। রনক্ষেত্রে একদিকে প্রয়োজন পড়ে অনড় মনোবলের এবং উন্নত সমানের সমরাস্ত্রের। সেই দিনে কোনোটিরই অভাব ছিল না মুসলিম জাতির।
পবিত্র কুরআন থেকে বিচ্যুতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার প্রতি অবজ্ঞা উন্নতমানের সমরাস্ত্র তৈরির প্রতি উদাসীনতা মুসলমান জাতিকে শ্রেষ্ঠত্বের আসন থেকে নীচে নামিয়ে দেয়। অথচ মুসলমানদের কাছ থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সবক গ্রহণ করে উইরোপীয়রা। উইরোপ থেকে সেই জ্ঞানের আলো পৌঁছে আমেরিকায়। এমন সময় উইরোপ ও আমেরিকা সামরিক শক্তি দিয়ে মুসলমানদের ছাড়িয়ে যায়। শুধু তাই নয়, উন্নত্তর সামরিক শক্তি নিয়ে ইউরোপ ঝাঁপিয়ে পড়ে মুসলিম দেশগুলোর উপর। কেড়ে নেয় তাদের মূল্যবান সম্পদ। এটাই আজকের মুসলিম জাহানের বাস্তবতা। আজকের এই অক্ষমতা শুধু মুসলমানদের জন্যই নয়, গোটা পৃথিবীর মানুষের জন্যও দুঃখের কারণ। পৃথিবীতে অনেক শক্তিধরদেশ আছে। কিন্তু ন্যায়নীতি সমুন্নত রাখর মতো দেশ কোথায়!! দ্বি-মুখী নীতি অনুসরণ করে না এমন দেশ কি খুঁজে পাওয়া সম্ভব? পক্ষপাত মুক্ত, নিরপেক্ষ ও ন্যায় পরায়ন কর্মনীতি অনুসরনের উজ্জ্বল উদাহরণ সোনালী যুগের মুসলমানদের ছাড়া আর কে কবে পেশ করতে পেরেছে? পৃথিবীবাসীকে পরিত্রাণ দিতে পারে মুসলিম জাতিই, যদি তারা আবার আঁকড়ে ধরে কুরআন ও হাদিস আর মনোযোগ দেয় জ্ঞান-বিজ্ঞানে এবং হাত দেয় উন্নত মানের সমরাস্ত্র উৎপাদনে। আশা করি বর্তমান দুনিয়ার সামগ্রিক প্রেক্ষাপট মুসলিম দেশগুলোর শাসকের চোখ খুলে দেবে।
মুসলিম বিশ্ব সম্পর্কে বিধর্মীদের কসাই সুলভ মনোবৃত্তির কারণ কি? যারা সাম্প্রতিক বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা করেন। তাদের সর্বসম্মত অভিমত হচ্ছে। ইহুদীরা মুসলিম উম্মাহর অস্তিত্ব বিলীন করে দেওয়ার একটি সার্বিক পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে। তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার উইরোপীয় সাঙ্গদের এ মর্মে ক্রমাগত ভীতি প্রদর্শন করছে। রাজনৈতিক ভাবে পূর্ণজাগরিত মুসলিম উম্মাহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব মোড়ালিপনার জন্য সর্বাপেক্ষা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। ইউরোপ, আমেরিকার ক্রমবদ্ধমান জ্বালানি চাহিদা পূরণ করার জন্য মধ্য প্রাচ্যের তেল সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলোর পাশাপাশি মধ্য এশিয়ার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলির মুখাপেক্ষিতা ক্রমেই প্রকট আকার ধারণ করছে।
আমেরিকা ক্রমেই মধ্য এশিয়ায় মুসলিম জনগণ অধ্যুষিত দেশগুলোর তেল সম্পদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য মরিয়া হয়ে উঠছে। মার্কিনদের জ্বালানি সম্পদের লোভে এ অঞ্চলের উপর আগ্রাসী তৎপরতা শুরু করাই স্বাভাবিক। তেল-গ্যাস ছাড়াও এই অঞ্চলে এত বিপুল পরিমাণ গন্ধকের মজুদ রয়েছে যে, পৃথিবীর আর কোথাও তা নাই। উল্লেখ্য যে, ভারী শিল্প-কারখানাগুলির জ্বালানি উপাদান হিসেবে গন্ধকের ব্যববহার অনেক ক্ষেত্রেই অপরিহার্য। তাছাড়া মূল্যবান সব খনিজ সম্পদ মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল গুলিতেই রয়েছে যার জন্য ইউরোপ ও আমেরিকা হুমড়ি খেয়ে আছে এ অঞ্চলের দিকে। আফগানিস্থানে পাশ্চাত্য সা¤্রাজ্যবাদীদের আগ্রাসন এবং ইরাকের উপর হামলাই মুসলমানদের ‘বরদাশত’ না করাই নগ্ন বহিঃপ্রকাশ। সুতরাং ইরাক, আফগানিস্থানে দখলদারী পাকাপোক্ত হওয়ার পরও আগ্রাসনের অবসান হবে বলে মনে হয় না। (সমাপ্ত)
লেখক : কলামিস্ট, সাংবাদিক
সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ