মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের অবদান অনস্বীকার্য। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু এর মূল মন্ত্র। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস, আর ২৬ মার্চ ১৯৭১ স্বাধীনতা দিবস। এ স্বাধীনতা কি শুধু মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধের ফসল? নাকি এ যুদ্ধ শুরু হয়েছিল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে। আমরা কি ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্র চেয়েছিলাম? না কি আমরা একটি ধর্ম নিরপেক্ষ স্বাধীন রাষ্ট্র চেয়েছিলাম! তাড়াহুড়া করে জন্ম নেওয়া পাকিস্তানের একটি প্রদেশ পূর্ব-পাকিস্তান পেয়েছিলাম।
সেখানে কি দেখলাম? বঙ্গভঙ্গের নীল নকশার বাস্তবায়নতো থাকলই, উপরন্ত পশ্চিমাদের একছত্র আধিপত্য বহাল হল। পশ্চিমারা তাদের স্বরুপ প্রকাশ করল। সর্বক্ষেত্রে পশ্চিমাদের শাসন কায়েম হল। সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে প্রশাসনের সর্বত্র পশ্চিমারা পদস্থ হল। আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলি তা কেরে নিতে চাইল। ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ বিকালে জিন্নাহ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হিসেবে প্রথম ঢাকা সফরে এসে ২১ মার্চ ৫টা ১৫ মিনিটে রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ কালে ঘোষণা করেন উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। সভাস্থলে দর্শক শ্রোতাদের মধ্য থেকে তৎক্ষনাৎ প্রতিবাদ ধ্বনি হয় না না না।
এর পরের ইতিহাস হল, প্রথমে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন। পরবর্তীতে অসাম্প্রদায়িক করার দর্শনে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ করা হয়। ৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট গঠন ও চুয়ান্নর নির্বাচন, যুক্তফ্রন্ট সরকারের অভ্যন্তরীন কোন্দল, যুক্তফ্রন্টের শাসনকাল, ২য় গণপরিষদ গঠন- ১৯৫৫, পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্র- ১৯৫৬, প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সামরিক শাসন (১৯৫৮-১৯৬৪), মৌলিক গনতন্ত্র প্রবর্তন, ১৯৬৫ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, শেখ মুজিবের ছয় দফা, আগরতলা মামলা, আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা, জেনারেল ইয়াহিয়া খান কর্তৃক সামরিক আইন ঘোষণা, সত্তরের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬০টি আসন একক ভাবে লাভ করে। প্রাদেশিক পরিষদের পূর্ব পাকিস্তানের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন লাভ করে। এ নির্বাচনের আগে আমরা কি দেখি- ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি সকল ক্ষেত্রেই পশ্চিম পাকিস্তানের একক অধিকারে চলতে শুরু করল। শেরে বাংলা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাষানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেকই বাঙলির সেই অবস্থা দেখে স্বস্তিতে ছিলেন না।
বঙ্গবন্ধু ছয় দফার ডাক দিলেন। তাকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়ানো হলো। উনসত্তরের গণঅভ্যুথ্যানে শেখ মুজিব একক নেতায় পরিগণিত হলেন। পাকজান্তারা ১৯৭০ -এ সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হল। সত্তরের ১২ নভেম্বর এক প্রলয়নকারী ঘুর্ণি-সাইক্লোনে ল-ভ- হয়ে গেল দক্ষিণের ভোলা, পটুয়াখালীর অনেক এলাকা। পাঁচ লক্ষের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিল। আর অসংখ্য গবাদি পশু মারা গিয়েছিল। পশ্চিমা কোনো নেতাই সহানুভূতি দেখাতে আসেনি। বঙ্গবন্ধু কিন্তু ঠিকই এসেছিলেন বন্যা পিরিত জন সাধারণকে দেখতে আর সহানুভূতি জানাতে।
সাধারণ নির্বাচনে একক ভাবে আওয়ামী লীগ জিতেছিল। কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানি সামরিক জান্তারা গডিমসি করতে থাকে। এরই মধ্যে আসে ৭ মার্চ ১৯৭১। ঐতিহাসিক ৭ মার্চে সোহরাওয়ার্দী উদ্দানে বঙ্গবন্ধু কালজয়ী এক ভাষণ দেন। রচনা হয়ে যায় বাঙালির মুক্তি সনদ। স্বাধীনতার এক বিরল কাব্য- এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। পশ্চিমারা বুঝেছিল, তাই তো অপারেশন সার্চ লাইট এর নামে ২৫ শে মার্চ রাতে ঢাকায় চালানো হল নিরহ বাঙালির উপর এক অমানবিক হত্যাক-! পিলখানা বিডিআর, রজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ও কোয়ার্টারগুলো, জহরুলহক হল, জগন্নাথ হল, শিববাড়ি, শাখারী বাজারসহ অসংখ্য ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ঘুমন্ত মানুষগুলোকে অস্ত্রশস্ত্র দ্বারা রাইফেল, ট্রাঙ্ক, সাজোয়া যান সহকারে একেবারে ল-ভ- করে দিয়েছিল। ভেবেছিল বাঙালিরা আর ভয়ে মাথাতুলে দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু না, বাঙালিকে দাবিয়ে রাখা অত সহজ নয়।
রাতেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষনা করেন। পরক্ষনেই তাকে বন্দি করে নিয়ে যায় পাকি-সামরিক জান্তারা।শুরু হয় আমাদের অসহযোগ আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধ। নয় মাস যুদ্ধ করে, ৩০ লক্ষ শহীদের তাজা রক্ত, ২ লক্ষ মা-বোনের সমভ্রামের বিনিময় আমাদের এ স্বাধীনতা। আমাদের স্বাধীনতার স্বপক্ষে যে কাজটি প্রতিবশি দেশ ভারত ও ইন্দিরা গান্ধী করে গেছেন তাকে ছোট করে দেখা যাবে না। ইন্দিরা গান্ধীকে আমাদের স্বাধীনতার পক্ষে সারা বিশ্বে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। আর সরাসরি যুদ্ধে তার বাহিনীকে কাজ লাগিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও আমাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন। এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় ও খাবার জুগিয়েছেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করেছেন। কত বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছিল পাক-জান্তারা। প্রথমে হিন্দু নর-নারী, বাড়িঘরে আগুন। কারা কারা আওয়ামী রাজনীতির সাথে যুক্ত, একে একে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সকলকেই যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষের লোকজনকে ওরা পাকিস্তানের শত্রু মনে করল। পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে যুক্ত হল স্বাধীনতা বিরোধীরা। তারা খুজে খুজে ধরিয়ে দিতে থাকল। মা- বোনদেরকে ধরে পাকিস্তানিদের কাছে যোগান দিতে থাকল।
শান্তি-বাহিনী, রাজাকার, আলবদর, জামাতিরা পাকিস্তানের বন্ধু হলো। বাঙালিদের ধরে ধরে হত্যা করা থেকে এমন জঘন্য কাজ নেই তা তারা করতে কোনো দিধাবোধ করেনি। সাম্পদায়িকতাকে উসকে দিতে তারা কখনো পিছপা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ হয় এক অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সকলেই এই বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করেছেন। ধর্ম নিরপেক্ষতা বাংলাদেশ তাদের হৃদয়ে ধারণ করেছেন। ধর্ম নিয়ে কোনো বাড়াবাড়ি থাকবে না। যার ধর্ম তার কাছে বড়। এটা নিয়ে বিরোধ হবে না। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই সমান সুযোগ নিয়ে এ দেশে বাস করবে। সকলকে সবাই সম্মান করবে। বাংলাদেশ হবে সব ধরনের বৈষম্যমুক্ত, অন্যায়, অবিচার ও শোষণ মুক্ত; অর্থাৎ অসাম্প্রদায়িক সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক দেশ। এটাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। আর আমাদের সেই হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি ছিল।
]বাঙালি সংস্কৃতি হিন্দু, মুসলিম, উচ্চবর্ণের হিন্দু, নি¤œবর্ণের হিন্দু, বৈষ্ণব, বাউল, আশরাফ, আতরাফ, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান- সবার সংস্কৃতি। শহরের, গ্রামের, ধনীর, গরিবের- তাবৎ মানুষের সংস্কৃতি। উৎসবে আনন্দে ভাগাভাগি করে নেওয়া- ধর্ম যার যার উৎসব সবার। যে বিভক্তি ইংরেজরা আমাদের মধ্যে ঢুকাতে চেয়েছিল, তা থেকে মুক্ত থাকা। একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশ হবে এ ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
লেখক : (অতিরিক্ত সচিব) চেয়ারম্যান, বিআইডবি�উটিসি
সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ