বর্ণবাদ বিষয়ে কুরআন ওয়ালি উল্লাহ সিরাজ
কৃষ্ণাঙ্গ, শ্বেতাঙ্গ। এই বিভেদটা চলে আসলে অনেক আগে থেকেই। হয়তো পৃথিবী সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই। কিন্তু ইসলাম কখনো কাউকে কৃষ্ণাঙ্গ বলে দূরে ঠেলে দেয়নি। আবার একজন শুধু শেতাঙ্গ এই জন্য তাকে কাছে টেনে নেয়নি। বরং ইসলামের দৃষ্টিতে সবাই সমান। এখানে তিনিই বড় বা তিনিই উত্তম যার তাকওয়া বেশি।
বিখ্যাত ম্যালকম এক্স একবার বলেছিলেন যে আমেরিকাকে ইসলাম বুঝতে হবে, কেননা ইসলাম ধর্ম সমাজের জাতিগত বিভেদ ও সমস্যা নিরসণ করে। একটি প্রকৃত ইসলামী সমাজে কোন প্রকার বর্ণবাদ বা বৈষম্য থাকে না। ইসলাম কখনো বর্ণবাদের শিক্ষা দেয় না। বর্ণবাদের ভিত্তিতে মানুষের মাঝে পার্থক্য করার শিক্ষা ইসলাম দেয় না। আল্লাহপাক মানুষকে বিভিন্ন ভাষা ও বিভিন্ন জাতিতে বিভক্ত করে সৃষ্টি করেছেন তাদের পরিচয় লাভের জন্য। আল্লাহপাক পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, হে মানব জাতি, আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ এবং একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। তারপর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে দিয়েছি যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পার। তোমাদের মধ্যে যে অধিক পরহেজগার সে-ই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদার অধিকারী। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাজ্ঞানী ও সবকিছু সম্পর্কে অবহিত। (হুজুরাত:১৩)
এ ছোট্ট আয়াতটিতে আল্লাহপাক সমস্ত মানুষকে সম্বোধন করে দুইটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক সত্য বর্ণনা করেছেন. এক. তোমাদের সবার মূল উৎস এক। একমাত্র পুরুষ এবং একমাত্র নারী থেকে তোমাদের গোটা জাতি অস্তিত্ব লাভ করেছে। বর্তমানে পৃথিবীতে তোমাদের যত বংশধারা দেখা যায় প্রকৃতপক্ষে তা একটি মাত্র প্রাথমিক বংশধারার বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা যা একজন মা ও একজন বাবা থেকে শুরু হয়েছিল। অথচ তোমরা এ ভ্রান্ত ধারণায় নিমজ্জিত আছো। একই আল্লাহ তোমাদের ¯্রষ্টা। এমন নয় যে, বিভিন্ন মানুষকে ভিন্ন ভিন্ন খোদা সৃষ্টি করেছেন। একই সৃষ্টি উপকরণ দ্বারা তোমরা সৃষ্টি হয়েছো। এমন নয় যে, কিছু সংখ্যক মানুষ কোন পবিত্র বা মূল্যবান উপাদানের সৃষ্টি হয়েছে এবং অপর কিছু সংখ্যক কোন অপবিত্র বা নিকৃষ্ট উপাদানের সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। একই নিয়মে তোমরা জন্মলাভ করেছো। এমনও নয় যে, বিভিন্ন মানুষের জন্মলাভের নিয়ম-পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন। তাছাড়া তোমরা একই পিতা -মাতার সন্তান। এমনটিও নয় যে, সৃষ্টির প্রথমদিকের মানব দম্পতির সংখ্যা ছিল অনেক এবং তাদের থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ আলাদা আলাদা জন্মলাভ করেছে।
দুই. মানুষের মধ্যে মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের বুনিয়াদ যদি কিছু থেকে থাকে বা হতে পারে তাহলে তা হচ্ছে নৈতিক মর্যাদা। জন্মগতভাবে সমস্ত মানুষ সমান। কেননা, তাদের সৃষ্টিকর্তা এক, তাদের সৃষ্টির উপাদান ও সৃষ্টির নিয়ম-পদ্ধতিও এক এবং তাদের সবার বংশধারা একই পিতা-মাতার পর্যন্ত গিয়ে পৌছে। তাছাড়া কোন ব্যক্তির কোন বিশেষ দেশ, জাতি অথবা জাতি -গোষ্ঠীতে জন্মলাভ করা একটি কাকতালীয় ব্যাপার মাত্র। এতে তার ইচ্ছা, পছন্দ বা চেষ্টা -সাধনার কোন দখল নেই। একদিক দিয়ে কোন ব্যক্তির অন্য কোন ব্যক্তির ওপর মর্যাদালাভের কোন যুক্তিসংগত কারণ নেই। যে মূল জিনিসের ভিত্তিতে এক ব্যক্তি অপর সব ব্যক্তিদের ওপর মর্যাদা লাভ করতে পারে তা হচ্ছে, সে অন্য সবার তুলনায় অধিক আল্লাহ ভীরু হতে পারে, মন্দ ও অকল্যাণ থেকে দূরে অবস্থানকারী হতে পারে বা নেকী ও পবিত্রতার পথ অনুগমনকারী হতে পারে। এরূপ ব্যক্তি যে কোন বংশ, যে কোন জাতি এবং যে কোন দেশেরই হোক না কেন সে তার ব্যক্তিগত গুণাবলীর কারণে সম্মান ও মর্যদার পাত্র। যার অবস্থা এর বিপরীত সর্বাবস্থাই সে একজন নিকৃষ্টতর মানুষ। সে কৃষ্ণাঙ্গ হোক বা শ্বেতাঙ্গ হোক এবং প্রাচ্যে জন্মলাভ করে থাকুক বা পাশ্চাত্যে তাতে কিছু এসে যায় না।
প্রকৃতপক্ষে গুণাবলীর দিক দিয়ে কারা উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন মানুষ আর কারা নীচু মর্যাদার মানুষ তা আল্লাহই ভাল জানেন। মানুষ নিজেরা নিজেদের উচ্চ বা নি¤েœর যে মানদ- বানিয়ে রেখেছে তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। হতে পারে দুনিয়াতে যাকে অনেক উচ্চ মর্যাদার মানুষ মনে করা হতো আল্লাহর চূড়ান্ত ফায়সালায় সে অতি নীচুস্তরের মানুষ হিসেবে সাব্যস্ত হবে এবং যাকে এখানে অতি নগণ্য মনে করা হয়েছে সেখানে সে অনেক উচ্চ মর্যাদা লাভ করবে। আসল গুরুত্ব দুনিয়ার সম্মান ও লাঞ্ছনার নয়, বরং কেউ আল্লাহর কাছে যে সম্মান ও লাঞ্ছনা লাভ করবে তার। তাই যেসব গুণাবলী আল্লাহর কাছে মর্যাদা লাভের জন্য উপযুক্ত আমাদের সকলের উচিৎ নিজেদের মধ্যে সেসব বাস্তব গুণাবলী সৃষ্টির জন্য সমস্ত চিন্তা নিয়োজিত করা।