দেখতে বৃদ্ধের মতো ৪ বছরের শিশু বায়েজিদ ঢামেক হাসপাতালে
রিকু আমির : অবিকল বৃদ্ধের মতো দেখতে সে। অথচ মাত্র চার বছর বয়স তার। বায়েজিদ নামের এই শিশুটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। শিশুটি জিনঘটিত বিরল রোগ প্রোজেরিয়ায় আক্রান্ত বলে প্রাথমিকভাবে চিকিৎসকদের ধারণা।
গতকাল শনিবার সকালে তাকে বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয় বলে জানান জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, সকালে ঢাকা মেডিকেলে আনার পর শিশুটিকে আমাদের কাছে ভর্তি করা হয়। আমরা একটি মেডিকেল বোর্ডের মাধ্যমে তার বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখব, কিভাবে তার চিকিৎসা করা সম্ভব। তিনি আরও জানান, এরই মধ্যে ছয় সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে, যার প্রধান বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের প্রধান অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ। মেডিকেল বোর্ডে থাকবেন- প্লাস্টিক সার্জারি বিশেষজ্ঞ, এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট, শিশু বিশেষজ্ঞ, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ।
হাসপাতালে বায়েজিদের সঙ্গে অবস্থান করছেন তার বাবা লাভলু শিকদার ও মা তৃপ্তি খাতুন। জানা যায়, চার বছর বয়সেই দেখতে বৃদ্ধের মতো হয়ে যাওয়া শিশু বায়েজিদের জন্ম মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলার খালিয়া গ্রামে। পাঁচ বছর আগে লাবলু তার আপন খালাত বোন তৃপ্তি খাতুনকে বিয়ে করেন। তার পরের বছর আগে বৃদ্ধের মতো চেহারা নিয়ে ভূমিষ্ঠ হয় বায়েজিদ। বর্তমানে তার বয়স চার বছর হলেও তার মুখম-ল ও দেহের কিছু অংশের বাহ্যিক দৃশ্য বৃদ্ধের মতো। এ অবস্থা নিয়েই বেড়ে উঠছে শিশুটি।
ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে শিশুটি প্রোজেরিয়ায় আক্রান্ত। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে বায়োজিদের মতো দেখাবে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হবে- এটা প্রোজেরিয়া নাকি অন্যকিছু। যদি প্রোজেরিয়াই হয়ে থাকে, তবে এটা পৃথিবীতে খুবই বিরল, বাংলাদেশে আমরা প্রথম এমন রোগী পেলাম। ফেসলিপ্টের মাধ্যমে তার মুখম-ল থেকে বাড়তি মাংস কেটে ফেলে স্বাভাবিক আকারে নেয়া যাবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কেন তার এই সমস্যা, দেহের কোথাকার সমস্যা থেকে এটা হলো- তা ঠিক হবে কি-না জানি না। তবে সম্পূর্ণ সরকারি খরচে তার জন্য সর্বোচ্চ চিকিৎসার ব্যবস্থাই করা হবে।
শিশুটির বাবা লাভলু শিকদার জানান, জন্মের পর থেকেই দিন দিন তার বার্ধক্যের ছাপ প্রকট হতে থাকে। মাগুরায় বায়েজিদের অনেক চিকিৎসা দেওয়া হলেও তার অবস্থার উন্নতি হয়নি। পরে মাগুরা সদর হাসপাতালের পাঁচ সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড তাকে ঢাকায় পাঠানোর উদ্যোগ নেয়।
বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে জানা যায়, শিশুরাই এতে আক্রান্ত হয়। রোগটি বিরল জিনঘটিত। যার ফলে আক্রান্ত শিশু অল্প বয়সেই দেখতে বুড়ো হয়ে যায়। রোগটি এতোই বিরল যে, গড়ে প্রতি আট মিলিয়ন শিশুর মাঝে মাত্র একজন প্রোজেরিয়ায় আক্রান্ত শিশু খুঁজে পাওয়া যায়। প্রোজেরিয়া রিসার্চ ফাউন্ডেশনের মতে, এখন পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে প্রোজেরিয়া সংক্রান্ত মাত্র ৩৫০ টি কেইস খুঁজে পাওয়া গেছে। অন্যান্য শিশুর মত স্বাভাবিকভাবে জন্ম নিলেও বয়স বাড়ার সাথে সাথে লক্ষণগুলো দৃষ্টিগোচর হয়। শুরুর দিকে যে লক্ষণটি দেখা যায় সেটি হল- আক্রান্ত শিশুর ওজন বৃদ্ধির মন্থর গতি। ১৮ থেকে ২৪ মাস বয়সে অন্যান্য লক্ষণগুলো আস্তে আস্তে প্রকাশিত হতে থাকে। আক্রান্ত শিশুর চেহারায় বিশেষ পরিবর্তন দেখা যায়, যেমন- বড় চোখ, সরু নাক, ছোট চিবুক, শীর্ণ ঠোঁট ইত্যাদি। তাছাড়াও আক্রান্ত শিশুর চুল পড়ে যায় যেটিকে টাক বলা হয়। উল্লেখযোগ্য আরেকটি লক্ষণ হচ্ছে- চামড়ায় ভাঁজ পড়া। প্রোজেরিয়ায় আক্রান্ত ৫ বছরের শিশুর ত্বকে ৭০ বছরের বৃদ্ধের মতই ভাঁজ পড়ে যায়। প্রোজেরিয়ার ফলে আক্রান্ত শিশুর হৃদপি-, দৃষ্টিশক্তিতে জটিল অসুখ দেখা দেয়। প্রোজেরিয়ার ক্ষেত্রে কোনো চিকিৎসাই তেমন ফলপ্রসূ বলে প্রমাণিত হয়নি। একজন প্রোজেরিয়া আক্রান্ত শিশুর গড় আয়ু মাত্র ১৩-১৪ বছর বলে জানা যায়।
শনিবার দুপুরে বায়েজিদকে নিজ কক্ষে দেখেন বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের অধ্যাপক ডা. সাজ্জাদ খন্দকার।
ডাক্তারের প্রশ্নের উত্তরে শিশুটির মা জানান, বায়েজিদ নিজ হাতে খেতে পারে, মাটিতে বসতে পারে। কিন্তু টয়লেটের জন্য বসতে পারে না। বিভিন্ন অক্ষর বলতে পারে, স্মৃতিশক্তি ভাল, সহজে কিছু ভুলে না। তার সব দাঁত ঠিক আছে। বিয়ের এক বছরের মধ্যেই বায়েজিদের জন্ম হয় বলে চিকিৎসককে জানান বায়েজিদের মা। সম্পাদনা : সৈয়দ নূর-ই-আলম