নাগরিক সমাবেশ ও একটি উপলব্দি
অজয় দাশগুপ্ত, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া থেকে : সাত মার্চের ভাষণ বিশ্বস্বীকৃতি পাওয়ার পর ঢাকায় যে নাগরিক সমাবেশ হয়ে গেল তাতে আমরা দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, লেখক-সাহিত্যিক-কবিদের দেখলাম অংশ নিতে। বিষয়টা রাজনীতির হলেও সে ভাষণ এখন আর দলের ভেতর সীমাবদ্ধ সব জাতির ইতিহাসে এমন ঘটনা থাকে না। কিছু ভাষণ ইতোমধ্যে দুনিয়ায় এমন উঁচু জায়গায় পৌঁছ গিয়েছে তাদের নিয়ে মানুষ আর তর্ক করে না। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা বহুধা বিভক্ত। যে মুক্তিযুদ্ধ আমাদের স্বাধীন করেছিল তার ইতিহাস নিয়েও আমরা এক থাকতে পারিনি। অমন একটি ভাষণ না হলে সেদিন কারও বাঁশির ফুঁয়ে দেশ স্বাধীন হতো আর বাঙালি যুদ্ধে যেত এমন ভাবনা যাদের মাথায় তারা আসলেই হঠকারী। বিএনপি এদেশের ইতিহাসে যে দুটো বড় ভুল করেছে তার একটি তাদের ঘোষক বিতর্ক। আনুষ্ঠানিক ঘোষণার কোনো প্রয়োজন আদৌ ছিল না সেদিন। ৭ মার্চের সে ভাষণ মূলত ঢাকাকে পাকিস্তান থেকে আলদা করে ফেলেছিল সেদিনই। এই জোয়ার, এই উদ্দীপনা এই ভালোবাসা আমরা আগে পরে আর কখনো দেখিনি। দেখবও না। আওয়ামী লীগের সমস্যা হলো তারা সবকিছু দেরীতে বোঝে। যখন তারা তা বোঝে বা মাঠে নামে তখন আর আসলেই করার কিছু থাকে না।
এবার তারা যে উৎসাহে, যে উদ্দীপনায় জাগল তার পেছনে আছে বৈশ্বিক স্বীকৃতি। প্রধানমন্ত্রীর একটা কথা বড় ভালো লেগেছে। তিনি বলেছেন, ইতিহাস তার প্রতিশোধ নিয়েছে। আসলেই তাই। আওয়ামী লীগ দল হিসেবে যত বড় আর বিশাল হোক না কেন এই বিতর্কে তারা বিএনপিকে টলাতে পারেনি। বিএনপির পেছনে থাকা জামায়াত বা একদা মুসলিম লীগের মেধা জিয়াউর রহমানকে বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছি নিয়ে যেতে পেরেছিল এটা তাদের বড় পাওয়া। কে না জানে মুক্তিযুদ্ধের সরকার বা তখনকার প্রশাসন ছিল আওয়ামী লীগের। সেখানে জিয়াউর রহমান কোনো ফ্যাক্টর ছিলেন না। এমনকি তিনি সেনাবাহিনীর দায়িত্বেও ছিলেন না। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে ছিটকে পড়া কর্নেল ওসমানী বা অন্যানভদের কাহিনী চাপা দিতে গিয়ে জিয়ার এই উঠে আসা ঠেকানো যায়নি। আজ এতবছর পর বিদেশিদের কাছে স্বীকৃত হওয়ার পর হালে পানি পাওয়া আওয়ামী লীগ যা করছে সে কাজ করা উচিত ছিল অনেক আগে।
এই সভায় অধ্যাপক আনিসুজ্জমানের মতো মানুষকে দেখে যেমন ভালো লেগেছে তেমনি কিছুটা বিস্মিতও হয়েছি। আমাদের এই প্রিয় স্যার আরও অনেক বুদ্ধিজীবীর মতো একসময় আওয়ামী লীগ বিরোধী হয়ে উঠেছিলেন প্রায়। সেটা যে কেউ হতেই পারেন। জীবনের নানা ঘটনায় আমি বা আমার মতো অনেকেই বর্তমান আওয়ামী লীগের সাথে চলতে পারি না। যারা মানুষের পাশে থাকেন তারা কোনো দলের অধীনে থাকতে পারেন না। কিন্তু তার মানে এই নয় তারা সুশীল সমাজের নামে কোনো দলের বিপদ আনতে গিয়ে ইতিহাস বা অতীতের কথা মনে রাখবেন না। একসময় সুলতানা কামাল, বদিউল আলম মজুমদার, মানবাধিকারের মিজানুর রহমান আর দেশের একটি সংবাদপত্রের সাথে তাল মিলিবে অনেকের মতো স্যারও পিছলে গিয়েছিলেন প্রায়। সে সময় আমরা তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবতাম তাহলে কি ইতিহাসে জিয়াউর রহমানের ঘোষণাই ঠাই পেয়ে যাবে? বিএনপির দেশ শাসনে আসাটা যখন প্রায় নিয়মিত হয়ে গেছিল তখন আমরা অনেকের বৈকল্য মনখারাপ করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারতাম না। বুদ্ধিবৃত্তির সহজ দিক হচ্ছে পালে হাওয়া দেখলে নিজের পথ খুঁজে নেওয়া। আর কঠিন দিকটা হলো কঠিন সময়ে সমস্যাকে মোকাবলে করে নিজেদের আলোয় দেশ জাতিকে পথ দেখানো। বহুকাল হয় আমরা এমন কাজ দেখি না।
তারপর ও সাত মার্চের ভাষণকে কেন্দ্র করে এই সমাবেশের একটা আলাদা গুরুত্ব আছে। মনে রাখতে হবে ক দিন আগে এক ই জায়গায় বিএনপি নেত্রী ভাষণ দিয়ে গেছেন। তার ভাষণে তিনি মাফ করে দেওয়ার কথা বলেছেন। এই মাফ শব্দটি আমাদের রাজনীতিতে নেই বললেই চলে। হঠাৎ করে এই মাফ করার কথা ঘরপোড়া গরুর কাছে সিঁদুরে মেঘের মতো। যেখানে ইতিহাস অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ বিষয়ে কোনো কথা নেই। মার্জনা কি মানুষের সঙ্গে মানুষের না দলের সাথে দলের না ইতিহাসের সঙ্গে বিএনপির রাজনীতির? সেটা পরিষ্কার না হলে আমরা ধরে নিতে পারি এখানে দুজন মানুষ বা কিছু মানুষের সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে। তাতে কি রাজনীতি বা দেশের কোনো লাভ আছে আসলে?
ফিরে আসি ৭ মার্চের ভাষণের কথায়। এই ভাষণটি নিয়ে সমাবেশ করলেই কাজ শেষ হবে না। এর দুনিয়াময় ব্যপ্তি আর প্রসার চাই। পৃথিবীতে সেরা ভাষণের যেসব সংকলন আছে তাতে এটি নেই। সেখানে ঢোকানোর কাজ না করলে আবারও ছিনতাই হতে পারে এই মূল্যবান ভাষণ। আত্মতৃপ্তি রাজনীতিকে এগোতে দেয় না। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এ জে পি আবদুল কালাম বলেছিলেন, স্বপ্ন হচ্ছ তাই যা মানুষকে ঘুমোতে দেয় না। জাগিয়ে রাখে। সে স্বপ্ন দেখা মানুষ বলেই কেউ বঙ্গবন্ধু তার কর্মকে দমাতে পারেনি। তিনি এই ভাষণে বলেছিলেন, দাবায়ে রাখতে পারবা না।
সেঅদম্য বাঙালির ইচ্ছা শক্তি আজ বহু জায়গায় অবদমিত। তাকে ভালোবেসে ঐক্যবদ্ধ থাকতে না পারলে সমাবেশের আলো দেশকে কতটা জাগাতে পারবে বলা মুশকিল। তবে এটা মানি শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কারণেই আজ দেশ ও জাতি এ জায়গায় আসতে পেরেছে। সে কারে তার দুশমনরাও সক্রিয়। দল যাই করুক দেশের মানুষের কাছে এখনো সাত মার্চের ভাষণ এক প্রেরণা। সে প্রেরণা যেন বহুলব্যবহারে মলিন না হয় আর আমরা যেন মনে করি এ ভাষণ সকলের। তবেই হয়তো সুদৃঢ় হবে আমাদের জাতিসত্তা।
লেখক: কলামিস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষক