পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির দুই দশক
পার্বত্য শান্তিচুক্তি জাতীয় আকাক্সক্ষার ফসল। এ চুক্তি রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার একক প্রচেষ্টার ফসল। শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে একাধিক সংলাপের পর পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নে শান্তিচুক্তির অসামান্য অবদান রয়েছে। তবে জনসংহতি সমিতি নিজেরা শান্তিচুক্তি শতভাগ মানতে ব্যর্থ হয়েছে। শান্তিচুক্তিতে তাদের সকল সদস্যর অস্ত্র সমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার শর্ত থাকলেও তারা তা করতে সফল হয়নি। ফলে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের শতভাগ আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য শতভাগ শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না বা বিলম্ব হচ্ছে। সে কারণে দুই দশক পরে এসে শান্তিচুক্তির একটি পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসে¤¦র রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পার্বত্য শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয় যা সমসাময়িক কালে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিম-লে সেই অঞ্চলের সমস্যার সফল রাজনৈতিক পরিসমাপ্তি; আর আমাদের দেশের জন্য এক বিরল অর্জন। একই সাথে এই উপলক্ষ্যে প্রাপ্ত ইউনেস্কো পুরস্কার পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের জন্য বয়ে আনে এক অনন্য স¦ীকৃতি। এ চুক্তির পরই পুরো পার্বত্যাঞ্চলজুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সুষ্ঠু অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিকাশ যথেষ্ট বেগবান হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের নির্দেশনায় সেখানে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকা- পরিচালিত হচ্ছে। উল্লেখ্য, ইতোমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তিচুক্তি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক স¦ীকৃতি লাভ করেছে। তবুও কিছু স¦ার্থান্বেষী মহল পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করার প্রয়াশ চালিয়ে থাকে। অপপ্রয়াস এবং বিভিন্ন অভিযোগ যে সত্য নয় এর বড় দৃষ্টান্ত শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের উল্লেখযোগ্য অংশসমূহের বিবরণ থেকে পাওয়া যায়। যেমন, ৩টি ‘পার্বত্য জেলা পরিষদ’ গঠন এবং নিয়ন্ত্রণাধীন ৩৩ দপ্তর/সংস্থার মধ্যে রাঙ্গামাটিতে ৩০টি, খাগড়াছড়িতে ৩০টি এবং বান্দরবানে ২৮টি দপ্তর/সংস্থা হস্তান্তর করা হয়েছে। ১২,২২৩ জন শরণার্থী পুনর্বাসন এবং শান্তিবাহিনীর সাবেক সদস্যদেরকে পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর অধিকাংশ ক্যাম্প প্রত্যাহার হয়েছে। অনুদান প্রদান করার সঙ্গে সঙ্গে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা প্রদান করা হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য কোটা প্রবর্তন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
একথা ঠিক পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন করে সেখানকার পরিস্থিতির মৌলিক অগ্রগতি সাধন জরুরি হয়ে পড়েছে। সেখানকার সমস্যার প্রকৃত রাজনৈতিক সমাধান ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় চুক্তি বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। সেখানে এখন সর্বত্র সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব বজায় নেই। তাদের ছত্রচ্ছায়ায় এবং সাধারণ প্রশাসনের সহায়তায় উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ও সেটেলার বাঙালিরা পাহাড়িদের উপর হামলা ও জায়গা-জমি দখল অব্যাহত রেখেছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে উপজাতি ও জুম্ম জনগোষ্ঠীর জাতীয় ও সাংস্কৃতিক অস্তিত্বকে আরও নাজুক অবস্থায় ফেলা হয়েছে বলে সন্তু লারমা একাধিকবার জানিয়েছেন। তার মতে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। উল্লেখ্য, শান্তিচুক্তি স¦াক্ষরের পর এ পর্যন্ত সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় নিরাপত্তা বাহিনীর স্পেশাল ওয়ার্কস অর্গানাইজেশন বা ইঞ্জিনিয়ার কনষ্ট্রাকশন ব্যাটালিয়নসমূহ পার্বত্য এলাকায় সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক কাজ করেছে। ইতোমধ্যে ৪৪২.২২ কিলোমিটার পাকা সড়ক নির্মিত হয়েছে; নির্মাণ কাজ চলছে আরও ১৪০.৭১৭ কিলোমিটারের। শান্তি চুক্তির গুরুত্ব দেখা যায় তুলনামূলক উন্নয়ন চিত্রে। বাস্তবায়িত প্রকল্পের অধিকাংশই স্থানীয় উপজাতিদের কল্যাণে পরিচালিত হচ্ছে। চাকমা উপজাতির জন্য মোট প্রকল্প ১৮৬ টি(৪৫%), অন্যান্য উপজাতিগুলোর জন্য মোট প্রকল্প ১৯৪টি(৪৬%)। অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের জন্য মোট প্রকল্প ৩৮০টি(৯১%)। পক্ষান্তরে বাঙালিদের জন্য মোট প্রকল্প ৩৬ টি (৯%)। পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানসহ মোট সদস্য সংখ্যা ৩৪। এর মধ্যে ১২টি অ-উপজাতির জন্য রাখা হয়েছে। চেয়ারম্যান পদটি সবসময়ের জন্য উপজাতি গোত্রের জন্য সংরক্ষিত। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়দের জন্য দেশের কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ এবং কিছু বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মোট ২১৭টি ভর্তি কোটা রয়েছে। গত ২০ বছর ধরে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকা- সফলভাবে পরিচালনার উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত থেকে পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অপরিহার্যতা লক্ষ করা গেছে। অন্যদিকে গত কয়েক বছর যাবৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের মধ্যে প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায়কে নিজ নিজ ধর্ম পালনে উৎসাহী করেছেন। এজন্য উপজাতিরা তাঁর কাছে যথাযোগ্য মর্যাদা পাবে- এটাই স্বাভাবিক। শেখ হাসিনার সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের আশা-আকাক্সক্ষা ও প্রত্যাশা পূরণে সর্বদা সচেষ্ট। সেই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে বর্তমান সরকারের কোনো অগণতান্ত্রিক ও জনবিরোধী উদ্যোগ নেই। গত মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিয়োগ পেয়েছেন। ভূমি কমিশন গঠন ও ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিল ২০১০’ জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশের অখ-তা রক্ষার জন্য উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের ধারণা সবাই মেনে নিয়েছেন। এর আগে একাধিকবার স্বার্থান্বেষী মহলের প্ররোচনায় পার্বত্য এলাকা থেকে বাঙালিদের উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র করা হলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। মূলত পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টাই গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক : অধ্যাপক এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা : আশিক রহমান ও মোহাম্মদ আবদুল অদুদ